বিরোধীতত্ত্বের আলোকে পাতাল রেল বন্দর নির্মাণ ও টেকসই উন্নয়ন

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ২৭ মার্চ ২০২১, ১০:০০

খুলনা শহরে আমাদের পাড়ায় মাগরিব নামাজের পরে এশার নামাজের আগে একজন ফকির আসতো। সে থাকতো আগাখানদের একটি মসজিদ ছিল শিরিষনগর এলাকায়-সেখানে।

সেখান থেকে রওনা দিয়ে শান্তিধাম মোড়, দোরখোলা মোড় হয়ে রায়পাড়া রোড দিয়ে মুসলমান পাড়া রোডের মাঝামাঝি পর্যন্ত যেত। ওই ফকির বেশ টাকা পেতো দান হিসেবে। কিন্তু সবসময় সে পাটের ছালা দিয়ে বানানো কাপড় পরতো। এরকম পাগল দিয়ে কিছু হয় না। তার ফুঁ সকলেই নিতো; কিন্তু কারো কিছু হতো না।কারণ, সমস্যা হলো বাস্তব। ফুঁ দিয়ে কিছু হয় না। এটাই বৈজ্ঞানিক। আর তাই মানুষ গবেষণা করে রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ বের করেছে। সেই বৈজ্ঞানিক যাত্রায় আজ করোনাভাইরাস থেকে বাঁচবার জন্য মানুষ ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে।

ভ্যাকসিন এখন চারটি দেশের নিয়ন্ত্রণে-চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। বাকিরা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়েছে অথবা উৎপাদনে ব্যর্থ। ভারত, বেলজিয়াম, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া উৎপাদন করছে। তারাও বেশ স্বস্তির মাঝে আছে। কথাটা বলবার মানে হলো- আমাদেরকে গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে। এবার ভারত ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে বলে আমরা বিপদ মোকাবেলা করতে পারছি। কিন্তু আগামীতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।সেজন্য আমাদেরকে ভাবতে হবে। ভ্যাকসিনের জন্য আমরা পরাধীন। আমরা ওই পরাধীনতা থেকে মুক্ত হতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শপথ নিতে চাই।

ওই ফকিরটা যখন দরখোলা মোড় অতিক্রম করতো তখন মসজিদের কোনায় এক হেকিম হামান দিস্তা দিয়ে কিছু একটা গুঁড়া করতো। সামনে মেলানো ছিল নানা গাছের মূল, ফল ও একটি জ্বলন্ত হেসাক। আর ওই পারে ছিল স্ট্রিট লাইট। হামান দিস্তায় ঐগুলো গুড়া করতে করতে বলতো, "আমার কথায় কোনো কাম হবে না"। আমরা তার কথাটা শুনে হাসতাম।

ওই হেকিমের মত, আমার বলতে হচ্ছে, আমার কথায় কাম হবে না। তবুও বলি। বলেই মনের শান্তি। আপনারা হয়তো হাসবেন। সেটি আমার অবদান। আপনার মুচকি হাসি আমার লেখা থেকে অর্জন। সেটাই আমার প্রাপ্তি।

যাঁরা ক্ষমতাসীন উনারা আমাদের থেকে ভালো বোঝেন। সুতরাং, আমার কথায় কাম হবে না। ওনারা জনপ্রতিনিধি। ওনারা সঠিক যেটা সেটা করেন। ওনাদের পাশে আছে এক্সপার্ট।তারা আরো ভালো বোঝেন। ওনারা আবার অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞান মনস্ক। ওনারা সত্য জানেন।পীর ফকিরের পানিপড়া কিংবা হুজুরের ফুঁতে বিশ্বাস করেন না। ওনারা প্রগ্রেসিভ।গণতন্ত্র বোঝেন। টকশোতে ফুলঝুরি ছড়ান। ওনাদের সঙ্গে কথায় পারাও কঠিন। আর তাই এখন উড়াল সড়ক থেকে নেমে পাতাল রেল নির্মাণের তত্ত্ব দিচ্ছেন।

এক বন্ধু বলছিলো গরিব শ্রমিকরা বিদেশে গায়ের ঘাম ফেলে টাকা পাঠাচ্ছে, সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে, আর দেশে ছেলে দামি জুতা আর গলায় সোনার চেন পরে ফুর্তি করছে। আমাদের নজর ভোগ্যপণ্যে। সরকারের কিছু মানুষের লোভ ওই টাকাতে। তারা আছে নাকি মেগা প্রকল্প -মেগা কমিশন এবং রাতারাতি দুর্নীতি করে ধনী হওয়া স্বপ্নে বিভোর। তারা পরিকল্পনাবিদ-রাজনীতিবিদেরকে বোকা বানিয়ে একটি fake উন্নয়ন তত্ত্ব দিয়ে ব্যাবসায়ীদের জন্য মেগা প্রকল্প নির্মাণ করছেন। আমরাও সেটা গিলছি।

মন্ত্রী-জনতা সকলেই দুটি সমস্যা স্বীকার করছেন। মশা এবং যানজট নগরের সমস্যা। যানজট সমস্যা নিরসনে তারা টানেল নির্মাণের কথা বলছেন। যানজট সমস্যা যে আরও বিকল্প পথে সমাধান করা যায় সেটা আমরা ভাবছি কি? আমরা ভেবেছি কি কাদের টাকায় আমরা টানেল নির্মাণ করে কাদের সুখ নিশ্চিত করছি? পরকাল বলে কি কিছুই নেই? জবাব দিতে হবে না? সারাজীবন ঘুষ খেয়ে শেষ জীবনে মসজিদে পড়ে থাকলে কি মাফ পাওয়া যাবে? যদি মাফ পাওয়া যায় তবে দোজখগুলো থাকবে না? আল্লাহ সব জানেন - তিনি পরম করুনাময়।

ওই হেকিমের মতো বলছি, আমার কথায় কাম হবে না। তবুও বলছি-টানেল দিয়ে সমাধান হবে না। কারণ যানজটের সমস্যা প্রাইভেট কার। সুতরাং, প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা আজকাল অনেক চালাকি করি। একটু ভালো কথা বলতে বঙ্গবন্ধুর নাম জুড়ে দেই।এবং ভেতরে ভেতরে সাবাড় করে দেই! এই চালাকি যে সরকার বোঝে না তা নয়। কিন্তু তারা তাদের মতো চলে।

যানজট নিরসনে বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। রাস্তায় বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে, বাসের মান ভালো করতে হবে এবং গাড়ি ও বাসের লেন আলাদা করতে হবে। গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে।

মশা মারার বিকল্প যেমন নেই তেমনি মশা যাতে জন্ম নিতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। দুটি সিটি কর্পোরেশন দিয়ে হবে না। পুরো ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন র্যাব এর মতো অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। তাকে পর্যাপ্ত জনবল দিতে হবে। র্যাব বাংলাদেশে একটি কাজ করে সফল হয়েছে। মাস্তানি -চাঁদাবাজি, খুন -খারাবি সহনীয় মাত্রায় রয়েছে তাদের সতর্ক পদক্ষেপের জন্য। যদিও তাদের কর্মকান্ড নিয়ে অনেক সমালোচনা-প্রতিবাদ আছে। আমরা স্কুলছাত্রদের আন্দোলন থেকে দেখেছি পুলিশ যেখানে ব্যর্থ সেখানে তারা সফল। ছাত্রদের সাফল্য তেমনি আমরা দেখেছি ৬৯, ৯০ এর গণ আন্দোলনে। তারা আয়ুবখান-এরশাদকে হটিয়ে দেখিয়েছে কিভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়।

ওই হেকিমেরমতো বলছি আমার কথায় কাম হবে না-তথাপি বলছি আমাদেরকে বিভাগীয় শহর, জেলাশহর, উপ-জেলাগুলোকে উন্নত করতে পরিকল্পনা নেয়া হোক। এবং এটি “গ্রাম হবে শহর”- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ। বন্দর বা টানেল নির্মাণ নয়, মানুষ যাতে ঢাকামুখী না হয় সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা টেকসই উন্নয়নের কথা বলছি এক দিকে অপর দিকে নির্মাণ করছি বন্দর-টানেল। এটা স্ববিরোধী। মশা মারতে হয়তো কামান দাগছি। একটু ভেবে দেখবেন কি? উন্নয়ন যাতে ন্যায় সম্মত হয়- আমাদের সকলকেই কিন্তু জবাবদিহি করতে হবে কোনো একদিন কোনো একজনের কাছে। আমরা কি সেদিন আমাদের মাথাটা নিচু করে রাখতে চাই?

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :