‘সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে, এটাই আশঙ্কার’

প্রকাশ | ২৯ মার্চ ২০২১, ০৮:৩১ | আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২১, ১০:০৮

বোরহান উদ্দিন

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে এ অতিমারীতের মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। মার্চ মাসের শুরু থেকে যেভাবে সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়ছে তা আশঙ্কাজনক বলছেন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন।

ঢাকাটাইমসকে দেওয়া সাক্ষাতকারে এ জনস্বাস্থ্যবিদ বলছেন, শুধু স্বাস্থ্যবিধি মানলেই হবে না, সংক্রমণের মূল উৎপত্তিস্থল বন্ধ করতে হবে। আক্রান্ত প্রত্যেকের খোঁজ রাখতে হবে। আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে।

করোনা সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতিকে কিভাবে দেখছেন?

করোনা শনাক্তের হার দিন দিন বাড়ছে। এটা অবশ্যই আশঙ্কাজনক। কারণ প্রথম ঢেউ শেষ হয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সবগুলো লক্ষণই এখানে আছে। তবে চার সপ্তাহ ধরে যদি শনাক্তের হার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে সেক্ষেত্রে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবো দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। কিন্তু এবারের যে ঢেউ এটা দ্রুত বাড়ছে। তাই আমাদের এটা আশঙ্কার বিষয়। গত নভেম্বরেও কিন্তু একটা চাপ ছিল। তখন সবাই মিলে সতর্কতা থাকার কারণে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।

করোনা শনাক্তের হার বাস্তবে আরো বেশি। কারণ গত কয়েকদিনে যাদের টেস্ট হচ্ছে তারমধ্যে ৫ থেকে ৬ হাজার লোক যারা প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন এবং অতিথি ছিলেন। কিন্তু এদের ছাড়া বাকিদের কথা যদি চিন্তা করা হয় তাহলে দেখা যাবে বেশি শনাক্ত হয়েছে। কারণ লক্ষণ নিয়ে যারা পরীক্ষা করছে তাদের মধ্যে শনাক্ত বেশি।

করণীয় কী?

এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের প্রত্যেকের খোঁজ রাখতে হবে। যদিও আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে খোঁজ রাখা হচ্ছে, কিন্তু তাদের তো পর্যাপ্ত জনবল নেই। যারা আক্রান্ত হচ্ছে আমরা যদি তিনদিনের মধ্যে তথ্য নিয়ে দেখি তারা চিকিৎসা নিচ্ছে কি না। তারা আইসোলেশনে আছে কি না। চিকিৎসকের সঙ্গে তার যোগাযোগ রাখতেই হবে। যাতে অবস্থা খারাপ হওয়ার আগে রোগীকে সারিয়ে তোলা যায়। তাহলে আইসিইউ দরকার হবে না। আর আইসোলেশনের বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। কারণ আমাদের দেশে একজন মানুষ ১৪ দিন অফিস না করলে সেখানে অন্য লোক নিয়ে নেয়া হবে। তাই সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। কারণ সংক্রমণ ছড়ানোর জায়গা যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে সমস্যা বাড়বে। তবে সবার আগে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

অফিসগুলোতে সামাজিক দূরত্ব মানার পাশাপাশি কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে এখন থেকেই। কারণ বদ্ধ ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ থাকার পর ফ্যান, ইসি চলবে তখন ভাইরাস আরো ছড়াবে। যে কারণে আক্রান্তদের আইসোলেশন এবং আশপাশের লোকদের কায়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের যেভাবেই হোক সংক্রমণের উৎপত্তিস্থল বন্ধ করতে হবে।

আমি নিজেও সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। কিন্তু আমরা অনেকে সরকারের ব্যর্থতাকে এড়িয়ে যাচ্ছি। স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলে আমরা সব পাবলিকের ঘাড়ে চাপাচ্ছি। শুধু স্বাস্থ্যবিধি নয়, যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইন যদি না করা হয় তাহলে তো গোড়া কেটে গাছের উপর থেকে পানি দেয়ার মত অবস্থা হবে। আমি স্বাস্থ্যবিধি মানলাম আর আশপাশে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘুরে বেড়ালো তাতে লাভ কি হবে।

টিকাগ্রহীতাদের জন্য পরামর্শ কি?

টিকা নেয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনেকের মধ্যে অনীহাভাব চলে এসেছে এটা সত্য। বিষয়টি মোটেও ঠিক হচ্ছে না। কারণ আপনার টিকা নেয়ার আগে এবং পরে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব করার কোনো সুযোগ নেই। মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানতেই হবে। কারণ সংক্রমিত হবেন না এমন নিশ্চয়তা কিন্তু টিকা দেয় না।

আবারো সাধারণ ছুটি তথা লকডাউনের...

বিষয়টি আমি জানি না। তবে আমি সবকিছু বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে না। জনস্বাস্থ্যগত সমস্যার সমাধান জোর করে বাধ্য করালে হবে না। ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে নামলে মানুষ সচেতন নয়, পুলিশ নামলে সচেতন হয়। মনে করে পুলিশ এসেছে মাস্ক পরি। কিন্তু জরিমানা করা হলেই কেবল মাস্ক পরবে সবাই এটা ঠিক না। কারণ ম্যাজিস্ট্রেটকে বুঝতে হবে জরিমানা করাটা তার অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটি। যদি জোর করে এমনটা করা হয় তাহলে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট চলে গেলে মানুষ মাস্ক খুলে ফেলবে।

আর লকডাউন বা সাধারণ ছুটি দিলে তো সরকারি চাকরিজীবীদের সমস্যা নেই। যত বিপদ হবে বেসরকারি চাকরিজীবীদের। কারণ অনেকের চাকরী চলে যাবে। তাই করোনা সংক্রমণের একবছরে এসে আমরা কিন্তু অনেকটা জেনে গেছি কিভাবে এটা কমানো সম্ভব। তাহলে সেটা ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রয়োগ করছি কেন? এরপরও যদি কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তখন লকডাউন বা সবকিছু তো বন্ধ করে দিতেই হবে। গতবছর কিন্তু যখন প্রথম মৃত্যুর সংবাদটি প্রচারিত হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে মানুষ রাস্তা ফাঁকা করে দিয়েছিল। এবার মনে হয় খারাপ পরিস্থিতি একটা লেভেল পর্যন্ত না গেলে মানুষজন রাস্তা ফাঁকা করবে না। তাই ধৈর্য ধরে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়ে মানুষকে আরো বেশি সচেতন করতে হবে।

মক আপ পদ্ধতি চালুর কথা বলছেন কেউ কেউ...

করোনার সংক্রমণটা বেশি হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে অতি সংক্রমিত এলাকায় এন্টিজেট টেস্টটা করা যেতে পারে। আপনি পরীক্ষা করার পর অল্প সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিয়ে যারা পজিটিভ তাদের আলাদা করে ফেলতে পারবেন আর যারা নেগেটিভ তাদের আলাদা করে ফেলতে হবে। সরঞ্জাম থাকলে আধাঘণ্টার মধ্যে কয়েক হাজার লোককে এভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এটার পরিকল্পনা এখনো হয়নি। কেউ কেউ প্রস্তাব দিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে সেটি করা কতটুকু সম্ভব?

শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দিয়ে এটা করা যাবে না। এখানে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক দরকার হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষিত করতে পারবে। বুঝতে হবে মহামারী মোকাবেলা কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট সংস্থার কর্মীদের দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব না। বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবককে এখানে কাজে লাগাতে হয়।

(ঢাকাটাইমস/২৯মার্চ/ডিএম)