বিশ্বের বিপজ্জনক সেতু, ভিতুদের যেতে মানা (পর্ব-১)

নাঈম লাবিব
 | প্রকাশিত : ০১ এপ্রিল ২০২১, ১১:২০

সেতু মানবজাতির ইতিহাসে এক অন্যতম সেরা নির্মাণমূলক আবিষ্কার। এই সেতু বহুকাল ধরেই আমাদের পূর্বপুরুষদের পানির উপর দিয়ে বা প্রতিকূল পথের জায়গাগুলোতে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যেতে বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে। অনেক পুরনো সেতুর বয়স শেষ হয়ে গেলেও আপনি দেখে অবাক হবেন যে এগুলো এখনো পূর্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে যা পর্যটকরা ব্যবহার করছে। অন্যদিকে কিছু আধুনিক সেতু রয়েছে যা আপনার শ্বাসরুদ্ধকর উচ্চতায় নিয়ে যায় এবং অবশ্যই এগুলো ভিতু লোকদের জন্যে নয়। এমনই ১০টি সেতুর বিবরণ এই পর্বে তুলে ধরা হলো।

১. হুসাইনি হ্যাংগিং ব্রিজ (পাকিস্তান)

এই সেতুটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা এই ছবিটি দেখে সহজেই অনুমেয়। দড়ির উপরের এই সেতুটি উপার হুঞ্জার বোরিট লেকের উপরে অবস্থিত। সেতুটির রক্ষণাবেক্ষণের উপর তেমন জোর না দেয়ার ফলে এটির অবস্থা অনেকটাই খারাপ এবং মানুষ পার হওয়ার সময় সেতুটি জোরে জোরে কাঁপতে থাকে। এমন অবস্থায় সামান্য ভুল হলেই সেতু থেকে আপনি সোজা হুঞ্জা নদীতে গিয়ে পড়বেন। তবুও ঘুরতে আসা কিছু সাহসী হাইকার সেতুটি পার হয়ে তাদের সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

২. ল্যাংকাউই স্কাই ব্রিজ (মালয়েশিয়া)

মালয়েশিয়ার এই বিখ্যাত সেতুটি মাটি থেকে প্রায় ৪০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই সেতুটি বেশ কয়েকবার বন্ধ হয়ে যায়। তবে অনেক সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার পরে মেরামত করে বর্তমানে সেতুটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে সকলের জন্যে। যদিও অনেকেই এর কাছেও আসতে চান না৷

পরবর্তীতে সেতুটি আবার অনিরাপদ বলে বিবেচিত হয় এবং পুনরায় গত ২ বছর ধরে এটিকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে৷ মূলত ল্যাংকাউইয়ের আশেপাশে একটি গুজব ছড়িয়েছিল যে, সেতুটি খুব দ্রুত ভেঙ্গে যেতে পারে। একারণেই বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷

৩. সেভেন মাইল ব্রিজ (ফ্লোরিডা)

এই সেভেন মাইল ব্রিজের নাম মূলত এর সাত মাইল দৈর্ঘ্যের কারণেই হয়েছে। সেতুটি ফ্লোরিডা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে নিচে নামে এবং লিটল ডাকের সঙ্গে সংযুক্ত করে। যখন এটি নির্মিত হয়েছিল, এটি ছিল বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুগুলোর মধ্যে একটি। এই সেতু মোট ৪টি পুরষ্কার অর্জন করেছে এবং এর মধ্যে বিশেষ একটি পুরষ্কার হলো ব্যয় সাশ্রয় করার জন্যে 'ফেডারেল হাইওয়ে' কর্তৃক গৃহীত পুরষ্কার। তবে এই সেতুটি যতটা ভয়ংকর ভাবছেন, ততটা ভয়ংকর নাও হতে পারে। কিন্তু হারিকেন চলাকালীন অবস্থায় এই সেতুতে আটকে পড়লে সেটা মোটেও সুখকর হবে না।

৪. ক্যারিক-এ-রেড রোপ ব্রিজ (উত্তর আয়ারল্যান্ড)

এই সেতুটি দেখে তেমন একটা ভয়ংকর মনে না হলেও কিছু সংখ্যক লোক এটিকে বেশ ভয়াবহ করে তুলেছে তাদের অভিজ্ঞতার দ্বারা। না না, চিন্তা করবেন না, তারা পড়ে যাননি। তারা শুধু এই সেতুর উপর দিয়ে দ্বিতীয় বার যাত্রা করার মতো সাহস করে উঠতে পারেনি। প্রথম বার কোনোমতে পার হলেও ফেরার পথে ফেরিতে করেই ফিরতে হয় তাদের। এই সেতুটি ভূমি থেকে ৩০ মিটার উপরে অবস্থিত যার নিচে রয়েছে অসমতল বিপজ্জনক পাথর আর খরস্রোতা পানির প্রবাহ। তবে এটা কিছুটা হলেও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তবে অবশ্যই সেই পর্যটককে হতে হবে অসীম সাহসের অধিকারী। নতুবা এর টিকেট না নেয়াই ভালো। ওপারে গিয়ে বসে থাকতে হবে।

৫. ডিসেপশন পাস ব্রিজ (ওয়াশিংটন)

এই ডিসেপশন পাস ব্রিজটি একাকী দূর থেকে দেখে বেশ ভয়ংকর মনে হয়। সেতুটি পানির ১৮০ ফুট উপরে অবস্থিত এবং এটি মূলত হুইডবি দ্বীপ ও ফিদালগো দ্বীপের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে৷ ১৯০০ এর দশকে স্থানীয়রা একটি ফেরী ব্যবহার করে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে ভ্রমণ করতো। তারা তাদের ঘোড়া, বগি ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়ে ফেরী আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতো।

বর্তমানে মানুষ সেতুটি ব্যবহার করে পারাপার হচ্ছে। তবে সেতুটি দেখার পর আমরা অনেকেই হয়তো ফেরি দিয়েই পার হতে চাইব।

৬. ব্রিজ অফ ইমমরটালস (চীন)

ব্রিজ অফ ইমমরটালস পূর্ব চীনের দক্ষিণ আনহুই প্রদেশের হুয়াংশান পর্বতশ্রেণীগুলোকে সংযুক্ত করে। ভার্টিগো অংশের সেতুটি খুবই ভয়ানক। তবে এখান থেকে যদি প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং ছবি তোলায় মন দেন তখন আর এই ভয় একদমই থাকবে না।

পাহাড়ের পাশে মাত্র কয়েকটি তক্তা দিয়ে তৈরি আরও একটি সেতু রয়েছে৷ এটির থেকে নিচে পড়লে যা হবে তা হয়তো কল্পনার বাইরে। আর আপনি যদি পার হবার জন্যে এই সেতুটি বেছে নেন তবে আপনি হয়তো উন্মাদ ভ্রমণকারী হিসেবে গিনেজবুকে নাম লেখাতে পারেন৷

৭. হ্যাংগিং ব্রিজ অফ ঘাসা (নেপাল)

এই শ্বাসরুদ্ধকর সেতুটি দেখেই প্রচণ্ড বিপজ্জনক মনে হয়৷ তবে গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যে এটিই একমাত্র এবং প্রধান যাতায়াতের পথ৷ সেতুটি মূলত আমদানি কাজের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। মানুষ এবং গবাদিপশু পারাপারের জন্যেই সেতুটি নির্মিত হয়েছিল এবং এখনো সেরকমটি হয়ে আসছে৷ সেতুটি অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং নদীর উপত্যকার উপর দিয়ে অবস্থিত। এটি প্রায় প্রতিদিনই দমকা বাতাসের সম্মুখীন হয় এবং খুব বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করে। স্থানীয়রা যদিও সেতুর এই অবস্থার সাথে মানিয়ে নিয়েছেন কিন্তু বাইরের পর্যটকদের অনেকেই এই পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। কারণ তখন মনে হয় সেতুটি হয়তো ভেঙ্গেই যাচ্ছে। যদিও এর রেলিং গুলো বেশ উঁচু উঁচু যা এটিকে কিছুটা হলেও নিরাপদ মনে করায়।

৮. স্টোরসেইসুন্ডেট ব্রিজ (নরওয়ে)

স্টোরসেইসুন্ডেট ব্রিজ অন্যতম সর্বাধিক পরিচিত এবং বিখ্যাত একটি সেতু। এই সেতুর একদম শীর্ষ থেকে অসাধারণ কিছু দৃশ্য উপভোগ করা যায়। তাছাড়া এটি নরওয়ের অন্যতম প্রধান পর্যটন রুটের মধ্যে একটি৷ এখান থেকে দৃশ্যগুলো অসাধারণ হলেও পথটা মোটেও সুন্দর নয়, বরং কিছুটা ভয়ংকরই বলা যায়। প্রায়ই সেতুটির একদিক থেকে দেখে মনে হতে পারে এর কোনো শেষ নেই এবং অসীম পর্যন্ত চলে গিয়েছে। আপনি যদি এই সেতুটির অভিজ্ঞতা নিতে চান তবে আমরা বলবো এই সেতুতে না গিয়ে বরং কোনো রোলার কোস্টারে রাইড নিয়ে নেন যা আপনার জন্যে অনেকটা সুখকর হবে৷

৯. কেশওয়া চাচা ব্রিজ (পেরু)

বেশিরভাগ সেতুই কাঠ বা স্টিল দিয়ে তৈরি করা হলেও কেশওয়া চাচা ব্রিজ বোনা ঘাস দিয়ে তৈরি। শুনতে বেশ অবাক লাগলেও এটিই সত্যি। আর ভয় পাওয়ার তেমন কারণ নেই, কারণ এই সেতুটি গত ৫০০ বছর ধরে এভাবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইনকা সভ্যতার লোকজন তাদের ব্যবহারের জন্যেই এ সেতুটি বানিয়েছিল। এজন্যে অবশ্য তাদের বেশ বড় একটি দল কাজ করেছে এটি তৈরি করতে। মহিলারা ছোট ছোট দড়ি বেধে দিত আর সেগুলোকে একত্রে করে পুরুষরা বড়, মোটা, শক্ত-মজবুত দড়িতে পরিণত করতো। আর সেগুলোই ধীরে ধীরে এই সেতুটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়। তবে আশ্চর্য এই সেতু ইনকা সভ্যতার মানুষের প্রতিভার অন্যতম এক নিদর্শন।

১০. ইশিমা ওহিশি ব্রিজ (জাপান)

এই সেতুটি দেখা মাত্রই আমাদের ভেতরে অনেক বড় কিছু করার অনুপ্রেরণা জাগায়। যদিও আমরা কোনো স্থপতি নই, কিন্তু এই সেতুটি দেখে ধারণা করাই যায় যে, এটি হয়তো পদার্থবিজ্ঞানের সকল সূত্রকে উপেক্ষা করেই বানানো হয়েছে। সেতুটি ১৪৪ ফুট উঁচু এবং এর নতির পরিমাণ ৬.১%। এই সেতুটি নির্মাণে সাত বছর সময় লেগেছিল। এটি জাপানের বৃহত্তম অনমনীয় কাঠামো এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম।

সত্যি বলতে আমরা অনেকেই হয়তো এই সেতুতে উঠার পরিবর্তে এর নিচের পানিতে সাঁতার কাটতে পছন্দ করব। কারণ এর উপর থেকে গাড়িগুলো কিভাবে খাড়া ঢালে নামিয়ে দেয় তা আসলেই বিস্ময়কর এবং ভয়ানক অনুভূতি জাগিয়ে তোলা এক ব্যাপার।

বিশ্বের বিপজ্জনক সেতু শুধু এগুলোই নয়। আরও এমন অনেক সেতু রয়েছে যেগুলো আপনাকে অবাক করবে। এমন আরও কয়েকটি সেতুর বিস্তারিত জানতে পারবেন পরবর্তী পর্বে।

ঢাকাটাইমস/০১এপ্রিল/একে

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :