লকডাউনের বিকল্প কী?

প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৪২ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৩৪

ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী

যে সমাধান সমস্যার চাইতে বহুগুণে খারাপ ফলাফল নিয়ে আসে, সেই ‘সমাধান’ লইয়া আমরা কী করিব? লকডাউনের ধারণাটা তাত্ত্বিকভাবে প্রমিজিং। কিন্তু এটি বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্য যে কয়টা শর্ত পূরণ করতে হয় তা আমাদের নীতি নির্ধারকরা জানেন বলে কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি এখন পর্যন্ত। গত বছর করোনাভাইরাসের যে স্ট্রেইনকে ৬০ দিনের ‘লকডাউন’ দিয়ে আটকানো যায়নি, তার চাইতে দ্বিগুণ সংক্রামক নতুন স্ট্রেইনকে রিলাক্সড লকডাউন দিয়ে কাবু করা যাবে, এমন চিন্তা পুরাপুরি অবান্তর। আর সত্যিকারের লকডাউন আমাদের দেশে কার্যকর করা যাবে এমন চিন্তা যারা করে, তাদের সাথে সত্যিকারের বাংলাদেশের কোনো যোগাযোগ আছে বলে মনে হয় না।  

একথা এখন একটা বাচ্চা ছেলেও মনে হয় বোঝে, যে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং কালচারাল কন্টেক্সটে সো-কলড লকডাউন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। গত এক বছর লকডাউন দিয়ে করোনার সংক্রমণ কমানো যায়নি বরং বেড়েছে। উল্টো এর ধাক্কায় চার কোটি মানুষ স্বাবলম্বী থেকে গরিব হয়েছে। আগের সেই ধাক্কাই কিন্তু এখনো চলমান। তাই কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ব্যালান্স নিয়ে এসি রুমে বসে দেশব্যাপী লকডাউনের চিন্তা যাদের মাথায় আসে, তারা হয় নবাব সলিমুল্লার উত্তরসূরী (যাদের ধারণা মানুষ ভাত না খেলে পোলাও খায়), অথবা এই লোকগুলো প্রচণ্ড অবিবেচক।

এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, লকডাউনের বিকল্প কী? উত্তর হলো, পায়খানা যখন আস্তে আস্তে লিক হচ্ছিল, তখন সরকার গা করেনি। চোখ বন্ধ রেখে প্রলয় ঠেকানোর নীতি নিয়েছে। করোনার ইউকে আর সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী জেনেও (আমি নিজেও এ-নিয়ে কয়েকটি সতর্কতামূলক পোস্ট করেছিলাম) এয়ারপোর্টে কার্যকরী সার্ভেল্যান্সের ব্যবস্থা  করেনি, এই ভ্যারিয়েন্টগুলো বাংলাদেশে কখন কতটা ছড়াচ্ছিল তা জানার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, ম্যাস লেভেলে এন্টিবডি ডিটেকশনের ব্যবস্থা করা হয়নি, মানুষকে সচেতন করার জন্য কার্যকরী কোনো ম্যাস-ক্যাম্পেইন হাতে নেয়া হয়নি। শুধু ভ্যাক্সিন-রাজনীতি করে সাময়িক ক্রেডিট নিয়ে বগল বাজানো হয়েছে। এ-কাজে স্বাস্থ্যখাতের নীতি নির্ধারকেরা পুরাপুরি দায়ী।

ইংরেজীতে একটা উপমা আছে- shit hitting the fan. অর্থাৎ পায়খানা যখন চলন্ত ফ্যানের পাখায় গিয়ে লাগে তখন চারপাশ যেমন মাখামাখি হয়, এই মুহুর্তে বাংলাদেশে করোনার অবস্থা হয়েছে ঠিক সে রকম। তাই এখন সমাধানের রাস্তাগুলো-ও মাখামাখি হবে, এটাই স্বাভাবিক।

একথা এখন দিবালোকের মত পরিষ্কার যে করোনায় সবচেয়ে বেশি হুমকিতে আছে ইতিমধ্যে বিভিন্ন রোগে ভোগা শহুরে জনগোষ্ঠী যাদের বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশের ওপরে। এই মানুষগুলো বরং নিজেদের বাড়িতে সেলফ-আইসোলেশনে থাকুক। বয়স পঞ্চাশের নিচে কিন্তু কো-মরবিডিটির রিস্ক ফ্যাক্টর আছে এমন মানুষেরাও চাইলে সেলফ-আইসোলেশন করতে পারেন। বাকিরা সামাজিক দূরত্ব মেনে মাস্ক পড়ে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাক। তার সাথে জনসাধারণের স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সবাই সেগুলো মানছে কিনা সেজন্য ব্যাপক-ভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নেয়া যায়। এর বাইরেও জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে (অথবা সাবসিডাইজড প্রাইসে) জিংক ট্যাবলেট আর ভিটামিন-ডি ক্যাপসুল বিতরণ ও ফুড ফর্টিফিকেশন প্রোগ্রাম হাতে নেয়া যায়। সাথে সবাইকে নিয়মিত দুপুরের রোদে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য উৎসাহ দেয়া যেতে পারে।

অনেকের কাছে এগুলো আইডিয়াল সলিউশন মনে না-ও হতে পারে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, আমরা কোনো আইডিয়াল প্রবলেমের মধ্যে নাই, বরং একটি ‘মাখামাখি’ হয়ে যাওয়া সিচুয়েশনে আছি। আর এটি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। তাই লকডাউনের মত স্বল্পমেয়াদী উপকারি কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর পন্থা পরিহার করে অধিকতর সাস্টেইনেবল উপায় নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, করোনা আমাদেরকে সহজে ছেড়ে যাচ্ছে না এটা নিশ্চিত।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একটা লং-টার্ম ইকনোমিক ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, করোনা তথা লকডাউনের ফলে সেটা যেন দুর্ভিক্ষে রূপ নিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সবশেষে নীতিনির্ধারকদের বলতে চাই, আপনাদের ব্যাংকে যে টাকা আছে, সত্যিই যদি এমন একটা ইকনোমিক ক্রাইসিস আসে, সামাল দিতে পারবেন তো?

লেখক: অণুজীব বিজ্ঞানী এবং জনস্বাস্থ্য গবেষক। সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়