নদীমাতৃক দেশে নদী মারার মহোৎসব!

শাহাবুদ্দিন শুভ
 | প্রকাশিত : ০৭ এপ্রিল ২০২১, ১৪:০২

নদী এখন জীবন্ত সত্তা বা লিভিং এনটিটি। কেউ চাইলে নদীকে এখন আর মারতে পারবে না। সাংবিধানিক ভাবে একজন মানুষের যেমন বেচে থাকার অধিকার আছে ঠিক তেমনি একটি নদীর ও বাঁচার অধিকার করে দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আমাদের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না’ তেমনি নদী যেহেতু জীবন্ত সত্তা তাকেও সংবিধান অনুযায়ী রক্ষা করতে হবে। তা নদীর মৌলিক অধিকার।

২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এক রায়ে তুরাগ নদকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে তা নিশ্চিত করে দিয়েছেন। ওই রায়ে তুরাগ নদসহ দেশের সব নদ–নদী রক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে অভিভাবক ঘোষণা করা হয়। আদালত বলেন, নদী দখল করা ব্যক্তি সব ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হবেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িত ব্যক্তি ব্যাংক ঋণ পাবেন না। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।

নদ-নদী বিষয়ক এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতির মর্যাদা অর্জন করল। বাংলাদেশে তুরাগ নদের এই স্বীকৃতির আগে ২০১৬ সালের নভেম্বরে কলম্বিয়ার ‘আত্রাতো’ নদী, ২০১৭ সালের মে মাসে নিউজিল্যান্ডের ‘হোয়াঙ্গানুই’ নদী এবং ভারতের উত্তরাখণ্ডের ‘গঙ্গা-যমুনা’ নদী এরকম ‘জীবন্ত সত্তা’ বা ‘আইনি সত্তা’র স্বীকৃতি লাভ করে।

সম্প্রতি খবরে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলায় একটি জীবন্ত নদীকে বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলার পায়তারা চলছে। ২ মাস আগে নদীটিতে বাঁধ দিয়ে তার গতি পথ পরিবর্তন করা হয়েছে। মৌলভীবাজারের জুড়ীর শাহপুর গ্রামের অনেকখানি জমি পতিত পড়ে ছিল। বছরের বেশির ভাগ সময় জলমগ্ন থাকে বলে এখানে কোনো চাষবাস করা যায় না। মাটি দিয়ে ভরাট করতে পারলেই শুধু জমিটাকে অর্থকরী করা সম্ভব। কিন্তু বাইরে থেকে মাটি কিনে কাজটা করতে গেলে অনেক ঝামেলা ও খরচ হবে বলে বিকল্প চিন্তা করলেন জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী। কণ্ঠিনালা নদীতে প্রচুর পলি জমে সেজন্য বাদ দিয়ে নদীর গতি পথ পরিবর্তন করতে পারলে জমি ভরাট হয়ে যাবে । কিন্তু এ জন্য তো টাকা লাগবে। বাঁধ দিতে হবে, খাল কাটার জন্য জমিও লাগবে। জায়ফরনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সার্বিক সহযোগিতায় টাকাটা তুলে দুই মাস আগে মাটি কেটে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পাল্টে ফেলেছেন তারা।

এত বড় একটা অনিয়ম যে হয়ে গেল, তা হয়তো এলাকার বাইরের কেউ জানতই না, যদি না তাৎক্ষণিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো না নদীর অপর পারের বাসিন্দারা। বাঁধ দেওয়ার কারণে পানিশূন্য হয়ে গেছে পাশের বেলাগাঁও, সেচের অভাবে নিষ্ফলা হওয়ার উপক্রম তাদের ফসলি জমি। বাঁধ অপসারণের দাবিতে তাই বাঁধের ওপর দাঁড়িয়েই মানব-বন্ধন করেছে তারা। আর এভাবেই বিষয়টা সম্পর্কে অবহিত হয়েছে বাইরের লোকজন।

এখন কথা হচ্ছে উপজেলা প্রশাসন এতদিন কি করলেন। এত বড় একটি কর্মযজ্ঞ হয়ে গেল কিন্তু তারা কিছুই জানলেন না। আর আদালত যে নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক করে দিলেন তারাই বা কি করলেন? এটা নিয়ে কেন মানব বন্ধন করতে হবে? কেন জাতীয় দৈনিকে সম্পাদকীয় লেখতে হবে?

মৌলভীবাজার জেলার নদ নদী নিয়ে আমি অনেক আগেই থেকেই উদ্বিগ্ন। সিলেটের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা সিলেটপিডিয়া ডটকম নামে একটি ওয়েবসাইটের জন্য নদীর তথ্য হালনাগাদের কাজ করতে গিয়ে নজরে এলো সরকারি তথ্যে নদীর সংখ্যা ও নাম নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।

যেমন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী মৌলভীবাজার জেলার নদীর সংখ্যা ৯টি। অন্যদিকে জেলা তথ্য বাতায়নের (moulvibazar.gov.bd) জেলা সম্পর্কিত মেনুর নদ-নদী সাব-মেনুতে ক্লিক করে দেখা যায়, মৌলভীবাজার জেলার নদীর সংখ্যা ৫টি। আবার ওয়েবসাইটেরই ‘এক নজরে জেলা’ পাতায় বলা হয়েছে এই জেলায় ‘প্রবাহিত নদীর সংখ্যা ৬টি।

তাহলে মৌলভীবাজার জেলায় প্রকৃত নদীর সংখ্যা কত? জেলার বাতায়নের কণ্ঠিনালা নদীর নাম খুঁজে পাওয়া গেলেও নদী রক্ষা কমিশনের ৯টি নদীর নামের তালিকায় এই নামটি নেই। তবে জুড়ি নদীর নাম এই তালিকায় এসেছে। অপরদিকে জেলা তথ্য বাতায়নের নদ-নদীর বর্ণনায় এবং এক নজরে জেলার তথ্য অংশে কণ্ঠিনালার ও জুড়ি নদী আলাদা আলাদা করেই এসেছে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন সময়ের খবরগুলোর অনুসরণ করে দেখা যায়, সেখানেও জুড়ি (জুড়ী বা জুরী বা জুরি নদী) ও কণ্ঠিনালা নদী আলাদা আলাদা করে গণ্য করা হচ্ছে।

তাহলে কণ্ঠিনালা নদীর নামটি নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় অনুপস্থিত কেন? নদীর অস্তিত্ব এমনিতেই সঙ্কটের মুখে। তার উপর যদি নদীর সংখ্যা ও নাম নিয়ে এই তথ্যবিভ্রাট হয় তবে হারিয়ে যাওয়া, হারাতে বসা নদীগুলোও আমাদের গবেষণা ও জানা থেকে হারিয়ে যাবে।

যখন এই লেখাটি লিখছি তখন জানতে পারলাম মানব-বন্ধন, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশ ও একটি শীর্ষ জাতীয় সম্পাদকীয় লেখার পর টনক নড়েছে প্রশাসনের। তারা বাঁধটি কে অপসারণ করা শুরু করেছেন। অতি সম্প্রতি হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় এড়া বরাক নামে নদীকে খাল বানানো নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশনে খবর বেড়িয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ প্রকল্পের নামে নদী কে খাল বানিয়ে ছোট করা হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে আমরা যদি দেশের ছোট নদী গুলোকে বাঁচাতে না পারি একসময় নদী খাল হয়ে মরে যাবে। এবং ছোট নদী গুলো মারে গেলে এক সময় বড় নদীগুলোর পানির ধারা কমে আসবে, ধীরে ধীরে বড় নদীগুলো আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। নদী যেহেতু আইনি ব্যক্তি বা জীবন্ত সত্তা তাই দেশের নদীগুলোকে রক্ষা করার জন্য অভিভাবককে সদা সর্তক থাকতে হবে। পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমাদেরকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে। নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, সিলেটপিডিয়া

ঢাকাটাইমস/৭এপ্রিল/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :