এফ এম শাহীনের অনবদ্য প্রয়াস ‘বাঙালি জাগরণের মহাজাদুকর শেখ মুজিব’

প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৫৬ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২১, ১৭:০১

সামিনা বিপাশা

বাঙালি জাগরণের মহাজাদুকর শেখ মুজিব। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে এফ এম শাহীনের অনবদ্য সৃষ্টি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য ব্যক্তিত্ব, মানবিক মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণা, অতুলনীয় সংগ্রামী জীবন ও অনন্য অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা, সুউচ্চ মতাদর্শের সঠিক উপস্থাপনে লেখক চমকপ্রদভাবে 'বাঙালি জাগরণের মহাজাদুকর শেখ মুজিব' বইটি সাজিয়েছেন।

বাঙালি জাগরণের মহাজাদুকর শেখ মুজিব বইটি ছাপান্ন পর্বে সাজানো। প্রথম থেকে শেষ পর্ব পর্যন্ত জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনকে শৈল্পিক নায়কোচিত উপস্থাপন করেছেন লেখক। বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে বইয়ের প্রতিটি পাতায়। উপলব্ধ হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক উচ্চতা ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার। 'লেখকের কথায়' উদার চিন্তার বিনয়ী এফ এম শাহীনকে আবিষ্কার করা যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এত দারুণ একটি বই লিখেও তিনি বলছেন বঙ্গবন্ধুকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা এবং যোগ্যতা কারো নাই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই লেখাটা যেন তার জন্য দুঃসাহসের, সত্যি এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, খুবই সুকৌশলে ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা যখন চারিদিকে আর সেইখানে লেখক তার ক্ষুরধার কলমে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য জীবনকে উন্মোচিত করেছেন অসাধারণভাবে। লেখক  অন্তরচক্ষু দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন, আর তাঁর জীবনের এমন সব গল্প বলেছেন যা আমাদের কাছে ছিল অপ্রকাশ্য। 

লেখক প্রথম পর্বে বলেছেন, 'হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ঘুমন্তপুরীকে জাদুর মায়ায় জাগিয়ে শত্রুনাশও করেছে, আবার নিজ প্রাপ্যের প্রতি কাতর হয়ে ধ্বংসের লীলাতেও মেতেছে। অপরদিকে বাঙালির জাগরণের মহাজাদুকর শেখ মুজিবুর রহমান অন্তরে-মন্তরে জাদুর তর্জনী নাঁচিয়ে সর্বদাই শুধু বাঙালির অধিকার-স্বাধীনতা-মুক্তির লড়াইয়ে আত্মপ্রাণ নিবেদনে অক্লান্ত ছিলেন। মহৎপ্রাণ শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ব্রত ছিল দুঃখিনী বাংলার মুখে হাসি ফোটানো, বাংলা মানুষের যোগ্য সম্মান-প্রাপ্য অধিকার আদায়, তাতে নিজের লাভ বা কারো ক্ষতির চিন্তাও তার চেতনায় ছিল না কখনো। বাঙালি অবাঙালি সর্বোপরি সমগ্র মানবজাতির শুভকামনা নিয়ে দাপিয়ে-কাঁপিয়ে জগৎময় ছিলেন, যতদিন পৃথিবীর নশ্বর বুকে ছিলেন।'

প্রথম পর্ব থেকেই দেখা যায়, অসাধারণভাবে লেখক বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনকে সব মানুষের পাঠোপযোগী করে উপস্থাপন করেছেন। পঞ্চদশ পর্বে বলেছেন, 'একুশ বছরের টগবগে যুবকের অপ্রতিরোধ্য আবেগের দাম অনেকের কাছে আর নেই। সেই দাম তিনি পাননিও কোনদিন! হ্যাঁ! এই যুবকটিই তো লড়েছিল পাকিস্তান আনার জন্য। কে তাকে শিখিয়েছিল? তোতাপাখির মতো মুখস্থ বলেছেন কিছু? তিনিতো নিজের তাগিদে অনুভব করেছে পাকিস্তান চাই! মুসলমানদের অধিকারের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদতো, তাই বলে হিন্দু সম্প্রদায়ের আন্দোলনে তিনি কী চুপ করে থেকেছেন? না!  তিনি লড়েছেন, লড়েছেন এবং লড়েছেন। সবসময় সবার জন্যই। আমরা উপমহাদেশ ভেঙে ভারত পেয়েছি, পাকিস্তান পেয়েছি, বাংলাদেশ পেয়েছি, স্বাধীন সার্বভৌম তিনটা রাষ্ট্র পেয়ে আমরা ভুলে গেছি ইতিহাস! নানা কায়দায় মুছে ফেলতে চাই অমর অক্ষয় সেই নাম।' 

বইটির দ্বাত্রিংশত্তম পর্বে লেখক বলেছেন, 'তিনি জনমানুষের দলে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের কথা বলেছেন, তাঁর ডাকে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙেছে বাঙালির, তাঁর জাদুতে বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছিল ঐশ্বরিক শক্তি। এটা জাদু বৈ অন্য কী হতে পারে! কবির ভাষায় ভেতো বাঙালি তো দুর্বল। এই বাংলার মানুষের না ছিল শক্তি, না ছিল ক্ষমতা, না ছিল অস্ত্র, না সামর্থ্য- কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ছিল এই বাঙালির, এই বাংলাদেশের। জাদুমন্ত্রে যিনি বাংলার মানুষকে বলীয়ান করে তুলেছিলেন শুধু ১৮ মিনিটের একটা ভাষণ দিয়েই! এই ১৮ মিনিটের অনবদ্য সময়টি ছিল ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ।'

নড়াইলের কালিয়ার হাড়িডাঙ্গা গ্রামের সাহসী সন্তান এফ এম শাহীন। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে তার কন্ঠস্বর সবসময়ই বলিষ্ঠ। লেখার বিষয় নির্বাচনেও তিনি সবসময়ই প্রতিবাদী এবং সাহসী। দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখক প্রথম বই রচনা করেছেন 'ছোটদের শেখ হাসিনা' এবং গণজাগরণ আন্দোলনের আদ্যোপান্ত নিয়ে দ্বিতীয় বই 'গণজাগরণের দিনগুলি।' তৃতীয় গ্রন্থের বিষয় নির্বাচনেও তিনি দূরদর্শিতা পরিচয় দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শিক্ষনীয় ও আদর্শিক জীবনকে ফুলের পাপড়ির মতো খুলে খুলে মেলে ধরেছেন পাঠকের সামনে, আবার সেই পাপড়ি দিয়ে মালা গেঁথে বিজয়মাল্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গলায় পরিয়েছেন। 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুসারী এফ এম শাহীন। দেশত্ববোধ ও স্বদায়িত্ববোধ থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনধর্মী এই বইটি লিখেছেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে এমন একটি পুস্তক খুব প্রয়োজন ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত। তার লেখনীতে সেই আমেজ দারুণভাবে পরিলক্ষিত হয়। সহজ সাবলীল মেদহীন বয়ানে বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি ঘটনাকে লেখক সহজবোধ্য অথচ সুদূর ইঙ্গিতবহ করে উপস্থাপন করেছেন। বইটি পাঠ করতে গিয়ে এর দুর্বল দিক মনে হয়েছে, কোনো কোনো পর্বে ঠিক তালে তালে যেতে পারেননি, সাহিত্যের মূল্যে কিছুটা দুর্বল বাক্য চয়ন হয়েছে, কিন্তু তার লেখায় এসব খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। কারণ, তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনের এমনসব ঘটনা নিয়ে হাজির হয়েছেন যে, এই বইটি পাঠ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। 

 

এফ এম শাহীনের চোখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাগরণের মহাজাদুকর। জাদুকরের মোহনীয় জাদুমন্ত্র ও জাদুশক্তির অতুলনীয় ক্ষমতাকে সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তুলে এনেছেন, অকৃপনভাবে তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামেকে। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা, এত দারুণ করে।

(ঢাকাটাইমস/০৮এপ্রিল/জেবি)