ভার্চুয়ালি হলেও সব আদালত খোলা চান আইনজীবীরা

প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০২১, ১৭:০১

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
ফাইল ছবি

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করায় সরকার দেশজুড়ে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতিতে স্বল্প পরিসরে আদালত চালু রাখার নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।  তবে আইনজীবীরা বলছেন, এমনিতেই প্রায় ৩৭ লাখ মামলা বিচারাধীন। আদালত সীমিত পরিসরে খোলা থাকলে মামলার জট আরও বাড়বে। এতে বিচারপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা ভোগান্তির শিকার হবেন। এজন্য ভার্চুয়ালি হলেও দেশের সব আদালত খোলা রাখার দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

গত ৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে চারটি ও আপিল বিভাগের একটি চেম্বার আদালত ভার্চুয়ালি খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া দেশের অন্যান্য আদালতগুলোতে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব পালন করার নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক তিনবারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সুপ্রিম কোর্টের কয়েকটি বেঞ্চ ও সারাদেশের বিচারিক আদালতগুলোতে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট বসে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করলে মামলা জট বাড়বে। সমস্যায় পড়বেন আইনজীবী ও মক্কেলরা। বিশেষ করে যাদের মামলা অনেক বছর হলো বিচারাধীন। এমননিতেই দেশে প্রায় ৩৭ লাখ মামলার জট। সীমিত পরিসরে কোর্ট খোলা রাখলে মামলা জট আরও বাড়বে। এজন্য পরিস্থিতি বিবেচনায় সীমিত না রেখে ভার্চুয়ালিভাবে সব আদালত খুলে দেয়া হোক।’

সিনিয়র এই আইনজীবী বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টসহ দেশে প্রায় ৬০ হাজার আইনজীবী এই পেশায় নিয়োজিত। তাদের রয়েছে চেম্বার জুনিয়র ক্লার্কসহ অনেক স্টাফ। করোনায় কোর্ট বন্ধ থাকলে এদের পরিবারে নেমে আসবে আর্থিক সংকট। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভার্চুয়ালি দেশের সুপ্রিম কোর্টসহ সব আদালত খুলে দিতে প্রধান বিচারপতির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

সব আদালত ভার্চুয়ালি রাখার আহ্বান জানান সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলও। ফেসবুক লাইভে এসে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকটি বেঞ্চ এবং সারাদেশে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট খোলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এতে করে কার্যত আমাদের এই পেশা এবং বিচার কার্যক্রম অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’

কাজল আরও বলেন, ‘রবিবার আদালত খোলা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমার মতামত গ্রহণ করার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই মর্মে অনুরোধ করি, তিনি যেন এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যাতে আইনজীবীরা তাদের পেশা সম্পূর্ণভাবে পরিচালনা করতে পারেন। আমি সমস্ত আদালত প্রয়োজনে ভার্চুয়ালই রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছিলাম। আমি আশা করব, লকডাউন যদি পরবর্তী সময়ে বৃদ্ধি পায় তাহলে আমার মতামত গ্রহণ করা হবে।’

আইনজীবীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা ও চিকিৎসার বিষয়ে সমিতির সম্পাদক বলেন, ‘করোনা যেভাবে বাড়ছে তাতে লকডাউনের মেয়াদ আরও বাড়তে পারে। সে কারণে অবিলম্বে বার কাউন্সিলকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে একটি আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করতে হবে।’

সোমবার (৫ এপ্রিল) মানববন্ধন করে আদালত খুলে দিতে আহ্বান জানান সাধারণ আইনজীবীরা।  তারা সুপ্রিম কোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সব অধস্তন আদালত খুলে দিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। সমিতি ভবনের সামনে তারা প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে এই আলটিমেটাম দেন। এ সময় সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সাধারণ আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন আহমদ মেহেদীর নেতৃত্বে আইনজীবীরা লকডাউনের মধ্যেও সুপ্রিম কোর্টে ভার্চুয়ালি বেঞ্চ সংখ্যা বাড়াতে এবং অধস্তন সব আদালত খুলে দেয়ার দাবি জানান।

শারীরিক উপস্থিতি ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিম্ন আদালতের বিচারিক কার্যক্রম খোলা রাখার সুপারিশ করে প্রধান বিচারপতির কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি খন্দকার মো. হজরত আলী। তিনি বলেন, এই কঠোর নিষেধাজ্ঞায় আদালতের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকলে আইনজীবী মক্কেলদের সমস্যা আরও বাড়বে, কমবে না। আমাদের অনেক জুনিয়র আইনজীবী আছেন তাদের জন্য এ সিদ্ধান্ত কঠিন বাস্তবতা বয়ে আনবে। তাই দেশের সব আদালত খোলার জন্য সুপারিশ করছি।

সুপারিশ গুলো হলো- কঠোর নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন আসামিদের হাজিরা ও সময়ের আবেদন আইনজীবীদের মাধ্যমে দেয়া যেতে পারে। দেওয়ানি মামলার বাদী ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করা যেতে পারে। হাজতি আসামিদের হাজিরা জেলখানা রেখে শুধু আসামিদের কাস্টাডি পেপার স্বাক্ষর করে আদালতে জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।

সিআর মামলা ফাইলিংয়ের বিষয়ে বাদী ও তার নিযুক্ত আইনজীবী সংশ্লিষ্ট আদালতে উপস্থিত থাকতে পারেন। আদালতের এজলাস কক্ষে একই সময়ে সীমিতসংখ্যক আইনজীবী মামলা পরিচালনা বা শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এজলাসের ডায়াসে এক থেকে দুজন আইনজীবী অংশগ্রহণ করতে পারেন। অল্পসংখ্যক আসামি উপস্থিত থাকতে পারে।

আদালতে প্রবেশ করার আগে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা। এজলাস কক্ষে বিচারপ্রার্থীদের বিনা প্রয়োজনে প্রবেশ সীমিত করা যেতে পারে। অস্থায়ী জামিন অটো এক্সটেনশন করা যেতে পারে। আপিল, রিভিশন ও মিস কেস ফাইলিং তামাদি থাকলেও ফাইলিং ও শুনানি হতে পারে।

বুধবার (৭ এপ্রিল) সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে আদালত খোলা রাখার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠান।

সভাপতি এটিএম ফয়েজ উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমানের দেয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, চলমান লকডাউনের সময় বিচারপ্রার্থী জনগণ ও আইনজীবীদের স্বার্থে নিম্ন আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য কিছু লিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যকীয়। সর্বোপরি লকডাউনের মেয়াদ বর্ধিত না করেও স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে আবশ্যকীয় পদক্ষেপগুলো মেনে কোর্ট পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশ প্রদান করতে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি সবিনয়ে প্রার্থনা করছে।

এদিকে ৬ এপ্রিল লকডাউনের মধ্যেই কোর্ট খুলে দিতে প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এএইচএম জিয়াউদ্দিন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ ফারুক হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবারই আছে। এজন্য সীমিত নয়, সব আদালত চালু রাখা জরুরি। দেশের প্রত্যেকটি আদালতে হাজার হাজার আইনজীবী উকালতি করছেন। লাখ লাখ মামলা ঝুলে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে আদালত সীমিত পরিসরে খোলা রাখলে মামলা জট বাড়বে। এজন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের প্রত্যেকটি আদালত ভার্চুয়ালি মাধ্যমে খুলে রেখে বিচার প্রার্থীদের বিচার নিশ্চিত করা হোক।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জে আর খান রবিন বলেন, ‘আমি মনে করি,  করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অবশ্যই দরকার। এজন্য ভার্চুয়ালি মাধ্যমে আদালত বাড়ানোতে প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। আদালত বন্ধ না রেখে ভার্চুয়ালিভাবে পরিচালিত হলে মামলা জট কমবে। বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি কমবে। আইনজীবী মক্কেলসহ সংশ্লিষ্টদের আর্থিক সংকট সৃষ্টি হবে না।’

(ঢাকাটাইমস/০৮এপ্রিল/এআইএম/জেবি)