‘মেঘডুবি’র বিচিত্র সব চরিত্র এবং লেখক কিঙ্কর আহসান

প্রকাশ | ০৯ এপ্রিল ২০২১, ১৬:০৯

জাহিদ রহমান, ঢাকাটাইমস

আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে হাজারো গল্প। জীবনের মোড়ে মোড়ে সে সব গল্প আমাদের স্বল্প সময়ের জন্য ভাবায় ঠিকই, কিন্তু আমরা সেসব স্মৃতিকে আশ্রয় দেই না। মানুষের পরিচিত সুখী চেহারাটার পেছনে দুঃখ গাঁথা জানা হয় না সময়ের স্বল্পতায়। ভালোবাসার মানুষটাকে বলা হয় না ভালোবাসি।

এক জনম পাশাপাশি বাস করে ছোঁয়া হয় না পাশের মানুষটার হৃদয়। মানুষের জীবনের সেই দুঃখ গাঁথা একসাথ করে বইয়ের পাতায় আনতে পেরেছেন কথা সাহিত্যিক কিঙ্কর আহসান। গল্পের মানুষ বলেই হয়তো মানুষের জীবনের আসল গল্পগুলো আঁকতে পারেন। তার সব সৃষ্টকর্মেই সে সব দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ পাওয়া যায়।

লেখকের এ পর্যন্ত প্রকাশিত নয়টি উপন্যাসেই সমাজের উঁচু তলার মানুষদের দিকে আঙ্গুল ওঠাতে দেখা যায়। সুখী মানুষের চেহারায় একবুক দুঃখ নিয়ে পার করে দেয়া মানুষের জীবনের চিত্র ফুটে ওঠে কখনো কখনো। লেখককে তার গল্প উপন্যাসের সব লেখাতেই দেখা যায় প্রচলিত অনাচার গুলোকে যেন আমরা এক রকম অলিখিত নিয়ম বানিয়ে ফেলেছি।

লেখক তার লেখায় সবসময়ই চরিত্রগুলো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, যেন চরিত্রের ইচ্ছেতেই লেখকের কলম চলছে। ‘মেঘডুবি’ উপন্যাসটিতে লেখকের সৃষ্ট বিচিত্র সব চরিত্রগুলো একদম ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবীর। চরিত্রগুলো এতটা বিচিত্র এতটা ভিন্নতা নিয়েও স্ব স্ব জায়গায় জীবনের মোড়ে একে অন্যের সাথে কীভাবে জড়িয়ে আছে তা নিয়েই মেঘডুবি উপন্যাস।

লেখক এতটা সফল ভাবে তার প্রতিটি চরিত্র আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন বলেই আপনি একই উপন্যাসে রাজা পাথরের সামনে থেকে সাঙ্গু নদীর স্রোত শুনতে পাবেন, আবার মুম্বাইয়ের জুহু বিচে সমুদ্রের গর্জনও শুনতে পাবেন। কোথাও এক মুহূর্তের জন্য গুলিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

গল্পের শুরু বাংলাদেশের প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল চট্টগ্রামের থানচি ইউনিয়নের সাঙ্গু নদীর পাড়ের ক্রাইককে দিয়ে। উপন্যাসের শুরুতে বোঝার জো নেই যে লেখক আপনাকে নিয়ে মস্ত এক বিশ্ব ভ্রমণে বের হচ্ছেন। সাঙ্গু নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে ক্রাইত রাজা পাথরের কাছে পায় বাবলু শিকদার নামে এক সরকারি কর্মচারীর পঁচা লাশ।

এই অংশ আমি যখন পড়েছি আমার মনে হয়েছে আমি রাজা পাথরের সামনে ক্রাইতের সাথে দাঁড়িয়ে আছি। ক্রাইত যে হালকা শীতল বাতাসে কাঁপছে আমি দেখতে পাচ্ছি। চারপাশের অন্ধকার হয়ে যাওয়া চোখে দেখছি। তখনও তো অজানা লেখক সুদূর সাইপ্রাসের শহর নিকোসিয়ায় নিয়ে যাবেন। স্থান ভেদে সমাজ ভেদে মানুষ যে দিনশেষে ওই একই, মেঘডুবি উপন্যাসে তা উঠে এসেছে।

সামাজিক আচার অনুষ্ঠান আর ভাষা আলাদা কিন্তু ভেতরের মানুষের তুলনা করতে গেলে মিল পাওয়া যায় অনেক। মানুষের এই মনের মিলেই সুকণ্যা খুঁজে পেয়েছে পাহাড়ি কিশোর ক্রাইতকে। লেখক কিঙ্কর আহসান তাহমিনা এবং সুকণ্যার মধ্যে স্বল্প সময়ের গভীর সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করেছেন দুই লাইনে, ‘এসব দেশ, সীমানা কিছুই নয়। পৃথিবীর আরেক নাম হলো ভালোবাসা, মমতা, বন্ধুত্ব।’

সময় মতো সব হবে আপাতত ক্রাইতের কাছে ফিরে আসি থানচিতে। বাবলু সিকদারের লাশ কথা বলে ওঠে ক্রাইতের সাথে। ভয় পেয়ে জ্ঞান হারায় ক্রাইত। লেখকের বর্ণনায় উঠে এসেছে ক্রাইতের পাহাড়ি জীবন এবং তাদের বাড়ির চিত্র। পাহাড়ি চম্পাফুল, গর্জন, বৈলাম গাছের কথা, ঝিঁঝিঁ পোকার ক্রিক ক্রিক শব্দ, মাথার উপরে কোটি কোটি তারা আর পাহাড়ের কুমলাং উৎসব।

লেখকের লেখার সাথে যারা পরিচিত তারা জানেন কিঙ্কর আহসানের লেখাতে বিভিন্ন রকম রান্নার রেসিপি থাকে। মেঘডুবির শুরুতেই এসেছে পাহাড়িদের এক ধরনের চাটনির রেসিপি। কাঁচামরিচ, পুদিনা পাতা, পেঁয়াজ, রসুন, সরিষার তেল, পরিমাণ মতো লবনের সাথে পিঁপড়ের ডিম মিশিয়ে তৈরি হয় এই চাটনি।

বাবলু শিকদারের লাশের ঘটনা পিছু ছাড়ে না ক্রাইতের। পুলিশ হানা দেয় বাড়িতে ক্রাইতের বাবাকে মারধর করে এবং বাবলু সিকদারের অস্ত্র সম্পর্কে জানতে চায়। কিছু বলতে না পারায় দেশদ্রোহীতার মামলায় থানা হাজতে রাখা হয় ক্রাইতের বাবাকে। ক্রাইতের সাথে থানায় প্রথম দেখা লেখকের। উপন্যাসের মধ্যেও এক লেখক আছে। সেই এক রকম সব গল্পটা বলে গেছে। লেখক অসম্ভব দক্ষতার সাথে একটা একটা গল্প বুনেছেন। চরিত্রগুলো সাড়া দিয়েছে বাস্তব চরিত্রের মতো।

পরবর্তী চরিত্র সুকণ্যা। সে গান পাগল মানুষ। এক সময়ের ভালোবাসার মানুষ স্টারলিংয়ের সাথে বিচ্ছেদের পরে তার জীবনে গানটাই সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে আছে। বাংলা গানের প্রতি অসম্ভব এই ভালোবাসার বীজ সুকণ্যার মনে বপন করেছেন ক্ষিতীশ যেঠু। অবাঙালি হয়েও মিষ্টি এই ভাষার প্রতি তাই এত টান।

গান নিয়ে এই বাড়াবাড়ি ভালো লাগে না সুকণ্যার বাবা-মায়ের। তাই লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে দেয় ব্রাইটন শহরে। সেখানেই দেখা হয় স্টারলিংয়ের সাথে। কিন্তু যার প্রথম ভালোবাসা গান তাকে কেউ কীভাবে আটকে রাখে? গানের জন্য সুকণ্যার একরকম স্টারলিংয়ের অমতেই চলে আসে কলকাতায়। কিন্তু গানের জন্য বুকভরা ভালোবাসা থাকলেও গানের পথ সুকণ্যার জন্য সহজ ছিল না।

বাংলা গানের বাজার ভালো নয়, সে জন্য সুকণ্যা চলে আসে মুম্বাইয়ে। হিন্দি গান গেয়ে বিখ্যাত হতে হবে। তারপর বাংলা গানের অ্যালবাম। সুকণ্য টের পায় তার স্বপ্নের পথ অনেকটা বাকি। স্বাধীন নারী চরিত্রের সুকণ্যার পারিবারিক ট্রাজিডিতে লেখক ফোকাস করেছেন। জীবনে নিজের মতো করে বাঁচতে গেলে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সেটাও দেখিয়েছেন। সব কিছুর পর আমার কাছে সুকণ্যার চরিত্রের ভালো লাগা এবং মন্দ লাগা এক জায়গাতেই।

সুকণ্যা অসম্ভব ইমোশনাল একটি মানুষ। সব ছেড়ে গানের কাছে চলে আসলেও স্টারলিংয়ের জন্য তার মন কাঁদে। মায়ের জন্য বাবার জন্য মন খারাপ করে। আবার তাদের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদও করে। তাই মায়া কাটাতে না পারা সুকণ্যার ভাগ্যে শুধুই কান্না। বাংলা গানের কাজে বাংলাদেশে আসা হয় সুকণ্যার সেখানেই পরিচয় শিশিরের সাথে। উপন্যাসের ভেতরের লেখকের সাথেও।

আমার মনে হয় গল্পে শিশির আসতেই জটিল হতে থাকে ‘মেঘডুবি’ উপন্যাস। শিশিরের মতো মানুষেরা সাময়িক সমস্যা সমাধান করতে একটার পর একটা ঝামেলা করে। শিশিরেরও একটা অতীত আছে। আছে ফুলের মতো ফুটফুটে একটা শিশুকন্যা। লোভই শিশিরকে খেলো। আর এসব গল্প বলে যাওয়া লেখককে? লোভের কথা বলা লেখককে মানায় না।

প্রবাস জীবনের লোভে পড়ে লেখাপড়ার জন্য বিদেশে যায় শিশির কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পরে বিপুল অর্থকষ্টে তার এই ধারণা ভাঙে। কিন্তু বাবার ভিটে বিক্রি করে আসে শিশিরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। জীবনে কিছু না করে দেশে ফিরবে না। সংগ্রাম চালিয়ে যায়। একটা সময়ে শিশিরের সব সমস্যার সমাধান হয়ে তার সাথে দেখা হয়ে যায় বিলেতের মেয়ে অ্যামেলিয়ার।

সাইপ্রাসে সে আসে ঘুরতে। ঘটনাক্রমে পরিচয় হয় অ্যামেলিয়ার সাথে এবং একটা সময় গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিশিরের কাছে অ্যামেলিয়া ছিল শুধুমাত্র একটি উপায় মাত্র। অ্যামেলিয়ার সময় লাগে বুঝতে। অ্যামেলিয়াকে বিয়ে করে বদলে যায় শিশিরের জীবন। স্বপ্নগুলো বাস্তব হতে থাকে শিশিরের। কিন্তু মানুষ ঠকিয়ে পার পাওয়া যায় কি? শিশিরের সব দুঃখ-কষ্ট কি এখানেই শেষ? শিশিরের চালাকির সামনে কি তবে সবকিছু হার মানবে? উত্তর আছে মেঘডুবি উপন্যাসে।

তাহমিনার চরিত্রটি সবচেয়ে মায়া লাগায়। তার কাছে সুখ সাময়িকভাবে ধরা দিলেও দুঃখটা সারাটা জীবনের। তাহমিনার চরিত্রটা পড়ে যে কারো চোখে পানি আসতে বাধ্য। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে বড় ভাইয়ের সংসারে স্থান পায় না তাহমিনা এবং তার ভাই ফুয়াদ। ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন তাহমিনার। ভাই ফুয়াদ বিদেশে চলে যায় তাহমিনার স্বপ্ন পূরণে। এদিকে তাহমিনা লেখাপড়ায় কোন মন নেই তার মাথায় প্রেম। অদ্ভুত এক প্রেম। এই ভালোবাসা কোথায় নিয়ে যাবে তাহমিনাকে! লেখকের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া তাহমিনা কি বুঝতে পারে লেখক তাকে ভালোবাসে? লেখক কি আদৌ কাউকে ভালোবাসে?

কিঙ্কর আহসান উপন্যাসের শেষ অব্দি রহস্যে রেখেছেন এই লেখক চরিত্রটাকে। তাহমিনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া লেখক কখনো বলে, ‘ইচ্ছে করে অন্ধ হয়ে যাই। এত সুন্দর সহ্য করা যায় না।’ আবার সেই লেখকেই দেখা যায় স্বার্থপরের মতো সব সিদ্ধান্ত নিতে।

শিশিরের বন্ধু মঞ্জুর উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মজার এই চরিত্রটি অসম্ভব অলস। সারাদিন ঘুম আর ঘুম। পৃথিবীর সব কাজে তার বিরক্তি। সব চরিত্র যখন একটার পর একটা ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে তখন মঞ্জুর চরিত্রটা আসলে অনেকটা মানসিক প্রশান্তি দেয়। সব মানুষ যখন জীবনটা জটিল করে তুলছে, মঞ্জুর তখন ঘুমের পেছনে ছুটছে। তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঘুম।

গল্পে প্রেমের আবির্ভাব হয় তাহমিনা লেখকের প্রেম থেকে। শিশিরের আর সুকন্যার প্রেমের বিশুদ্ধতার কাছে হেরে যায় সব। আসলেই কি তাই! হিরণ সাহেব চরিত্রটি কাল্পনিক এবং হিংস্র মনে হয়। কিন্তু হিরণ সাহেবরা আমাদেরই একজন। পৃথিবীর সব মানুষ এদের কাছে ভোগ্য বস্তু। ক্ষমতার দাপটে এরা করে সবকিছু। হিরণ সাহেবদের কি কিছুই হয় না!

সামাজিক উপন্যাস মেঘডুবি আমার কাছে অসম্ভব রকম জীবন্ত একটি উপন্যাস। এর স্থান চরিত্র সবকিছুই অত্যন্ত প্রাণবন্ত। লেখককে দিয়ে সম্পূর্ণ উপন্যাসের গল্পটি বলিয়ে নিয়েছেন কিঙ্কর আহসান। সেই লেখকের জন্য আমার অসম্ভব মায়া, কিন্তু কিঙ্কর আহসান লেখকের প্রতি একটুও মায়া দেখাননি। দিনশেষে উপন্যাসটি আমার মাথায় গেঁথে যাওয়া একটি উপন্যাস। প্রতিটি চরিত্র আমাকে ভাবায়। লেখকের সফলতা এখানেই।

সবশেষে লেখকের ভাষায় বলতে চাই,

জটিল জীবন হয় না সরল,

যায় নিভে যায় আলো,

মানুষ তুমি গাছ হয়ে যাও,

ফুল ফোটালেই ভালো!

ঢাকাটাইমস/০৯এপ্রিল/এআর/এএইচ