নানা শঙ্কায় ঢাকা ছাড়ছে মানুষ

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২১, ২১:১০ | প্রকাশিত : ১০ এপ্রিল ২০২১, ২১:০০

১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউনের ঘোষণা আসছে। জরুরি সেবা-পণ্য ছাড়া বাকি সব কিছুই বন্ধ থাকবে এই লকডাউনে। চার দিন পর থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনের সময় আবারও বাড়ানো হবে কিনা সে বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে গুঞ্জন চলছে। সরকারিভাবে এমন প্রজ্ঞাপন দেয়ার আগেই এমন কিছু অজানা শঙ্কা নিয়ে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন হাজারো মানুষ।

শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের বাড়তি চাপ দেখা গেছে। কেউ ঢাকা ছাড়ছেন পণ্যবাহী যানবাহনে, কেউবা পায়ে হেঁটে।

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়লে ২৩ মার্চ প্রথমবার সাধারণ ছুটির ঘোষণা করেছিল সরকার। ওই সময় সব অফিস আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছুটির মধ্যে সব কিছু বন্ধ থাকার সেই পরিস্থিতি ‘লকডাউন’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

করোনার সংক্রমণ কমে আসায় আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হতে থাকে। মার্চের শেষ দিকে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে ভাইরাসটির বিস্তার রোধে সারাদেশে গত ৫ এপ্রিল থেকে সরকার ঘোষিত সাত দিনের বিধিনিষেধ শুরু হয়, যা শেষ হবে আগামীকাল রবিবার।

বিধিনিষেধের কারণে মানুষের কাজ ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দেশের প্রতিটি সিটি এলাকায় যান গণপরিবহন চালু এবং শুক্রবার থেকে দোকানপাট ও শপিংমল খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এমন অবস্থার মধ্যে করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউন দেয়ার চিন্তা করছে সরকার।

গতকাল কঠোর লকডাউন দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, ঘোষিত লকডাউনের সময় জরুরি সেবা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে। এছাড়া যানবাহন চলাচল, কলকারখানা ও পোশাক কারখানাও বন্ধ থাকবে। এছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বিষয়টি জানান।

দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যর পর ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন অনেক মানুষ। যানবাহন না চলায় অনেকে পায়ে হেঁটে গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। আবার অনেকে বেশি ভাড়া দিয়ে বিকল্প উপায়ে গ্রামের বাড়ির পানে ছুটছেন।

শনিবার ঢাকার আমিনবাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা ছেড়ে যেতে মানুষের বাড়তি তোড়জোড়। আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকা ছাড়তে নগরবাসী যে যার মত পথ খুঁজে নিয়েছেন। কেউ ঢাকা ছাড়ছেন পণ্যবাহী পিকআপ ভ্যান ও মিনি ট্রাকে, কেউ যাচ্ছেন পায়ে হেঁটেই। পরিস্থিতি দেখে কিছুটা ঈদের আগ মুহুর্তের অবস্থা মনে হলেও এটি নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা নয়, যারা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন তারা মূলত লকডাউনের শঙ্কায় নগর ছেড়ে যাচ্ছেন।

বাড়িমুখো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই দিনমজুর শ্রেণির। আসছে লকডাউন কঠোর হলে তাদের ঢাকায় থাকা কষ্টকর হতে পারে। কর্মহীন হওয়ার এমন আশঙ্কায় তারা আগে থেকেই গ্রামের পথে রওনা হয়েছেন।

ঢাকা ছেড়ে কুড়িগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন শাহজাহান মিয়া। আমিনবাজার কথা হয় তার সঙ্গে। ঢাকাটাইমসকে শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘লকডাউন দিছে, ঢাকায় থাইকা কি করুম? বাড়ি যাই। গাড়ি তো বন্ধ। পিকআপে কইরা চন্দ্রা মোড়ে যাই। যাইয়া দেখি গাড়ি পাওয়া যায় কিনা।’

শুধু দিনমজুরই নন, ছিন্নমূলদের মধ্যে বিভিন্ন ছোট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এবং ছোট ব্যবসায়ীরাও যুক্ত হয়েছেন ঢাকা ছাড়ার মিছিলে।

ঢাকার মিরপুরের তুলা ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান ঢাকাটাইমসকে জানান, চলমান কঠোর স্বাস্থ্যবিধিতে তার ব্যবসা বন্ধ। সামনের লকডাউনে ব্যবসা হবে আশা করতে পারছেন না তিনি। তাই আগে থেকেই ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন।

আনিসুর রহমান বলেন, ‘এখনি ব্যবসা নাই। এইখানে থাইকা লাভ কি? দোকান ভাড়া পকেট থেকে দিতাছি। খাওয়া খরচ। বাসা ভাড়া সবই বেশি। বাড়ি গেলে খাওয়া খরচ আর বাকি বাড়তি খরচগুলো তো বাচবে।’

মোহাম্মদপুর থেকে পিকআপ ভ্যানে করে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন গেসু মিয়া। ঢাকাটাইমসকে তিনি জানান, প্রতি বছর ঈদের আগে সবাই মিলে বাস ভাড়া করে তারা গ্রামের বাড়িতে যান। এবারের ঈদের বিষয়টি তাদের মাথাতেই আসছে না। বরং লকডাউনে কি হবে তা নিয়ে চিন্তিত তারা।

ভ্যানগাড়ি চালক গেসু মিয়া বলেন, ‘এখনি তো কামকাজ নাই। লকডাউন দিলে তো ঘর থেকেই বাইর হইতে দিব না। তখন কি করুম? চলুম ক্যামনে? আমগো তো জমাইন্না ট্যাকা নাই। ঘর ছাইড়া দিছি। ঈদের পর সব ঠিক হইলে আইসা ঘর নিমু।’

ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলো জানান, দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকায় ভেঙে ভেঙে বাড়ির পথে যেতে হচ্ছে তাদের। এতে বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে তাদের।

এদিকে কম খরচে ঢাকা ছাড়তে রাজধানীর কারওয়ানবাজার এলাকায় ভিড় করেছেন উত্তরবঙ্গের মানুষ। দিনমজুর মানুষগুলো রাতে কারওয়ানবাজারে সবজি নিয়ে আসা ট্রাকে করে বাড়ি ফিরবেন বলে সেখানে ভিড় করেছেন।

গাইবান্ধা যাওয়ার জন্য কারওয়ান বাজারে অপেক্ষমাণ আউয়াল মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘এইবার নাকি কড়া লকডাউন দিব। রিকশা চালাইতে পারুম কিনা জানি না। তাই আগেই বাড়ি যাই।’

মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্য বিত্তদের মধ্যেও রয়েছে ঢাকা ছাড়ার তোড়জোড়। তবে তাদের ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার মাধ্যম ভিন্ন। স্বপরিবারে ঢাকা ছাড়তে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা বেছে নিয়েছেন প্রাইভেটকার।

ফার্মগেট থেকে শনিবার রাতে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন তুহিন। স্বপরিবারে ঢাকা ছাড়তে একটি প্রাইভেটকার ভাড়া করেছেন তিনি।

তুহিন বলেন, ‘দোকান খোলা এখন নামে। ব্যবসা নাই। লকডাউন দিয়ে কবে খুলবে তার কোনো ঠিকঠিকানা আছে? তাই সবাইকে নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি। যদি এরমধ্যে লকডাউন তুলে নেয়, তাহলে আমি চলে আসব। বাকিরা গ্রামেই থাকবে।’

চলমান পরিস্থিতির অনেকটা সুযোগ নিচ্ছেন রেন্ট এ কার ব্যবসায়ীরা। তুলনামূলক অনেকটা বেশি ভাড়া আদায় করছেন তারা। এমন অভিযোগ জানিয়েছেন তুহিনসহ অনেকেই।

নগরীতে রাইড শেয়ারকারীদের একটি বড় অংশ নিজ মোটরসাইকেলে করেই ছেড়ে যাচ্ছেন ঢাকা। চলমান নির্দেশনায় রাইড শেয়ারিং বন্ধ রয়েছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন তারা। আসন্ন লকডাইনে কি হবে এমন শঙ্কা মাথায় নিয়ে নগর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান তারা।

আমান উল্লাহ নামের একজন রাইড শেয়ারকারী বলেন, ‘অ্যাপসের মাধ্যমে যাত্রী উঠাইলেও মামলা দেয়। দিনে এক হাজার টাকা ইনকাম হয় না। এক হাজার টাকার, দুই হাজার টাকার মামলা খাওয়া লাগে। কই থেকে টাকা দিমু? এর চাইতে বাড়িতে যাওয়া ভাল।’

এছাড়া রাজধানীর মহাখালী, সায়েদাবাদ, সাইনবোর্ড এলাকা থেকেও পণ্যবাহী যানবাহনে ঢাকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে অনেককে।

ঢাকাটাইমস/১০এপ্রিল/কারই/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :