বাবা খোকা; শেখ লুৎফর রহমান

আব্দুল্লাহ আল হাদী
 | প্রকাশিত : ১০ এপ্রিল ২০২১, ২১:৪৪

‘বাবা খোকা।

শত ২ দোয়া জানিবা। তোমার ২৯/৪/৬২ তারিখের চিঠি এক মাস পরে পাইলাম। ঢাকা হইতে ছোট বউ চিঠি লিখিয়াছিল যে, তুমি শীঘ্রই মুক্তি পাইবে ---।’

৯ জুন ১৯৬২ এর একটি রিপোর্টে এই চিঠিটি পাওয়া গেছে। চিঠিটির তারিখ লেখা ৩১ মার্চ ১৯৬২, জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রিসিপ্ট ডেট মেমো- ৫ জুন ১৯৬২।

চিঠিটি এসেছে লুৎফর রহমান, টুঙ্গিপাড়া থেকে সিকিউরিটি প্রিজনার শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। চিঠিটিতে সরকারের বিরুদ্ধে কথা আছে বলে চিঠিটি তখন উইথথেল্ড করা হয়েছিল।

চিঠিটি পড়ার আগে একটু বলে নেওয়া দরকার এবার বঙ্গবন্ধু মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয় ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২, এর আগে বঙ্গবন্ধু মুজিব আইয়ুব সরকারের মার্শাল-ল'র মধ্যে আগের দফা (১২ অক্টোবর ১৯৫৮-১৭ ডিসেম্বর ১৯৫৯) জেল খেটে বের হয়ে একই সরকারের সময়ে আবার জেলে গেলেন।

এবারো বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব জেল গেটে বঙ্গবন্ধু মুজিবের সাথে বেশ কয়েক বার দেখা করলেন। ৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারের পর ৮ ফেব্রুয়ারির ১৯৬২, একটি এপ্লিকেশনের তথ্য থেকে জানা যায়- শেখ লুৎফর রহমান ঢাকায় এসেছেন গ্রামে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মা অসুস্থ সেজন্য ছেলেকে খবর দিতে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার একদিন পূর্বেই বঙ্গবন্ধু মুজিবকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। সেজন্য তিনি (শেখ লুৎফর রহমান) ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২, ছেলের সাথে জেলগেটে দেখা করতে গেলেন সঙ্গে ছেলের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, মমিনুল হক এবং চিলড্রেন (মাইনর)।

গোয়েন্দা তথ্যে এরপর দেখা যায় জেলগেটে বঙ্গবন্ধু মুজিবের সঙ্গে বঙ্গমাতার আরো কতগুলো সাক্ষাৎ, যে সাক্ষাৎগুলো থেকে যা যা জানা যায়- ৫ মার্চ ১৯৬২, তাঁদের বাড়ি চুরির একটি ঘটনা। ১০ মার্চ ১৯৬২, ঈদ উপলক্ষে জেলগেটে পারিবারিক সাক্ষাৎ। ২৯ মার্চ ১৯৬২, বড় মেয়ের এক সপ্তাহের উপর জ্বর সেজন্য তিনি ছেলে শেখ কামাল উদ্দিনকে নিয়ে সাক্ষাতের দরখাস্ত দিয়েছেন। ২৮ মে ১৯৬২, বোনের অসুস্থতার খবরে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পূর্বে সাক্ষাতের জন্য আবেদন। ৪ জুন ১৯৬২, আরেকটি সাক্ষাৎ আবেদন থেকে জানা যায় ছেলে শেখ কামাল উদ্দিন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন সেজন্য তাঁর স্বামী শেখ মুজিবের সঙ্গে দ্রুত সাক্ষাৎ প্রয়োজন। একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন সে সময় বঙ্গমাতা এপ্লিকেশন দিলেই যে সাক্ষাৎ পেয়েছেন তা কিন্তু নয়। সে সময়ের এধরনের সাক্ষাতের তথ্যের পাশাপাশি আরো দেখা যায় বঙ্গবন্ধু মুজিবের কাছে সে সময়ে লেখা কতগুলো চিঠি-পত্রও উইথেল্ড করা হয়েছিল।

রিপোর্টগুলোতে দেখা যায় সে সময়ে উইথেল্ড হওয়া সেই চিঠি-পত্রগুলোও সেখানে সন্নিবেশিত করা আছে। সেখান থেকে একটি চিঠি। চিঠিটি শেখ লুৎফর রহমানের লেখা, ৮০ বছরের একজন বয়স্ক পিতা মিথ্যা মামলায় আটক তাঁর রাজবন্দি ছেলেকে লিখছেন এভাবে খোকা সম্বোধনে।

"বাবা খোকা।

শত ২ দোয়া জানিবা। তোমার ২৯/৪/৬২ তারিখের চিঠি এক মাস পরে পাইলাম। ঢাকা হইতে ছোট বউ চিঠি লিখিয়াছিল যে, তুমি শীঘ্রই মুক্তি পাইবে এবং কয়েক দিন পরেই সকলকে লইয়া আমাদের দেখিতে আসিবে কিন্তু আজ ২০/২৫ দিন হইয়াছে আর কোনও সংবাদ পাইতেছি না। "খোদা তায়ালা বলিয়াছেন তাহার বান্দাকে যে নির্যাতন করিবে আমি তাহাকে নির্যাতন করিব"। ইহা পূর্বাপর ঘটনা হইতে সকলেই জানিতেছে এবং দুনিয়ার ইতিহাসও তাহা স্বাক্ষ্য দিতেছে। বেশী দিন হয় নাই তুমি নিজেও দেখিতে পাইয়াছ। তোমাকে আটক করিয়া রাখার অর্থ হইতেছে আমাদের মতন বৃদ্ধ পিতা মাতার, নাবালক ছেলে-মেয়েদের এবং স্ত্রীর উপর অত্যাচার করা। আমরা উপায়হীন সহ্য করিতে বাধ্য কিন্তু খোদা তায়ালা নিশ্চয়ই সহ্য করিবেন না। চিন্তা করিবা না সব কিছু খোদা তায়ালার উপর নির্ভর তিনি যাহা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যেই করেন। সত্যের জয় হইবেই। নানা রূপ মিথ্যা মোকদ্দমা চাপাইয়া তাহাতে কোনও ফল না পাইয়া তোমার সততার ছাফাই পাইয়াছে তাহা সত্ত্বেও তুমি কিছু না করিলেও তোমাকে কেন যে আটকাইয়া রাখিতে হইবে তাহাই বুঝিতে পারিতেছি না। শুনিয়াছিলাম তোমাকেই সর্ব্বাগ্রে মুক্তি দিবে কিন্তু এখনও তাহার কোনও সম্ভাবনা দেখিতেছি না। দেশবাসী প্রায় সকলেই_সরকার গোচরে সকল প্রকার রাজ বন্দীদের এবং ছাত্রদের মুক্তির প্রার্থনা দিয়াছে। মনে হয় শীঘ্রই তোমাদের মুক্তি দিবে। মা রেনুর চিঠী পাইয়াছি তাহারা সকলে ভাল আছে। মীরার মার হাপানী উঠিয়াছে। সে গোপালগঞ্জে শুনিলাম যে একটু ভাল হইয়াছে। আমরা বাড়ির সকলেই ভাল আছি। তোমার মেজ বুজির শরীর খুবই খারাপ। সব সময় দোয়া করিতেছি এবং খোদার দরগায় প্রার্থনা যে তিনি তোমাদের মঙ্গল করুন। ৮০ বৎসর বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এখন লেখা খুবই কঠিন। তাই খুব ধীরে ২ লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরী হয়।

ইতি-

তোমার আব্বা"।

বঙ্গবন্ধু মুজিবের বাবার সাথে ছিল তাঁর কথা বলাবলি আর বোঝাপড়ার সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু মুজিব তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের সাথে গভীর রাত পর্যন্তও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন।

বঙ্গবন্ধু মুজিব তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তাঁর পিতার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন এভাবে যে, তাঁর পিতা তাঁকে বলছেন- "বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করবো না, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না, লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।"

সে ব্রত থেকেই হয়ত বঙ্গবন্ধু মুজিবের নিপীড়িত মানুষের জন্য আজন্ম লালিত মুক্তির স্বপ্ন, সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন, আগামী বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন পরাজিত হবার নয়।

[Secret Document Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, vol-7. page- 140.

লেখক: কবি ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :