‘সোনার হরিণ’ দরকার নেই!

মো. কামাল হোসেন
| আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৪৯ | প্রকাশিত : ১১ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৩৭

কয়েক দিন ধরে পত্র-পত্রিকা আর টেলিভিশনে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণকারী সংবাদের অন্যতম ছিল করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ঊর্ধ্বগতি। মনোবেদনার কারণ হলেও এ সংবাদের প্রতি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনোযোগ ছিল এমনকি এখনও আছে।

পরিসংখ্যান বলছে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুহার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দেশে প্রতিদিন সাত হাজারের বেশি মানুষ নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যুও বেড়েছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যু যেখানে ছিল ৬৪, দ্বিতীয় ঢেউয়ে এক দিনে মৃত্যুর সর্বোচ্চ সংখ্যা ৭৭ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মার্চের প্রথম সপ্তাহে করোনা শনাক্তে নমুনা পরীক্ষায় প্রতিদিন মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী চিহ্নিত হলেও সম্প্রতি শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৪ গুণ বেড়েছে।

দেশে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। সঙ্গে বাড়ছে জনগণের অবহেলা ও উদাসীনতা। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে রাজধানীতে করোনা আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা প্রদান ক্রমেই দুরূহ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ অবস্থা বিরাজ করছে।

স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ করোনা স্বাস্থ্যবিধি শতভাগ মেনে না চললে সামনে কঠিন বিপদ। যেভাবে নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে তার কয়েক শতাংশ রোগীকে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি করতে হলে হাসপাতালগুলো বেডের অভাবে রোগী ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হবে। বেড ফাঁকা না থাকলে টাকা খরচ করেও চিকিৎসা পাওয়া যাবে না। এতদিন মুমূর্ষু করোনা রোগীদের জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) বেড পাওয়া কঠিন হলেও ক্রমেই সাধারণ বেডই ‘সোনার হরিণ’ হয়ে উঠছে।

এত ভয়ংকর সব খবর আসলে আমরা মনে রাখি না। কিংবা রাখার প্রয়োজন বোধ করিনা। করোনায় ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ এর ভয়াবহতা অনুভব করতে পারছে না। আর সে কারণেই কেউ মাস্ক পরছে না, কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। স্বাস্থ্যবিধি ভাঙতেই যেন প্রতিযোগিতা। সম্প্রতি সনাতন ধর্মের অনুসারীদের দুটি স্থানে পুণ্যস্নান প্রশাসন থেকে বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। যাতে করে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের ফলে করোনা সংক্রমণ না বাড়ে।

বাস্তবতা দুই জায়গাতেই স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত ফজিলতময় দিন। গত জুমার দিনে মিরপুরের একটি মসজিদে নামাজ আদায়কালে দেখেছি অনেকের মুখে মাস্ক নেই। অনেক মুসল্লির সমাগম হয়েছিল সেদিন, সেখানেও স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা উপেক্ষিত ছিল। কাঁচাবাজার আর মাছ মাংসের বাজারে স্বাস্থ্যবিধি নিরুদ্দেশ অনেক আগে থেকেই।

বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বৃহস্পতিবার এক প্রজ্ঞাপনে বলেছে শুক্রবার থেকে দোকানপাট ও শপিংমল সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। তবে এ সময় স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন না করা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে ৫ এপ্রিল থেকে যে 'লকডাউন' শুরু হয়েছে বাংলাদেশে শুরু থেকেই তার বিরোধিতা করছিল ব্যবসায়ীরা। দেশের বেশ কিছু জায়গায় এনিয়ে দোকানি ও ব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা থাকলেও সরেজমিনে তা মানার বিষয়টি তেমনভাবে দেখা যায়নি বলে অধিকাংশ গণমাধ্যমে খবর এসেছে। কিছু কিছু দোকানে ক্রেতাদের বেশ ভিড় দেখা গেছে। দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই অধিক সংক্রমণঝুঁকি নিয়ে মার্কেট, দোকানপাট খুলছে গত শুক্রবার। সরকারের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে শপিং মল, মার্কেটসহ সকল প্রকার বিপণিবিতান খোলা রাখতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।

শুক্রবার থেকেই রাজধানীর মার্কেটেগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। বেচাকেনাও বেশ ভালো বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। আর মার্কেট খোলা থাকায় কেনাকাটা করতে আসছেন বলে জানান ক্রেতারা। মার্কেটের ভেতরে গিজগিজ করছে লোকজন। ক্রেতা বিক্রেতাদের প্রায় সবার মুখে মাস্ক থাকলেও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি কেউ মানছেন না। না বিক্রেতা না ক্রেতা। তবে বিক্রেতাদের চেয়ে ক্রেতাদের স্বাস্থ্য বিধি না মানার প্রবণতাটাই বেশি লক্ষ্যণীয়। ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে জিনিসপত্র দেখছেন। অন্যদিকে বিক্রেতারাও হ্যান্ড স্যানিটাইজ করা কিংবা জীবাণুনাশক স্প্রে করা কোনোটাই চোখে পড়েনি। এক কাস্টমার গেলে আরেক কাস্টমারকে কিভাবে দোকানে বসানো যায় তাই নিয়ে হাক ডাকে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন দোকানিরা।

লোভের গুড় পিপড়ায় খায় বলে বাংলায় একটি প্রবাদ আছে। এর নিগুঢ় অর্থ অতি লোভ করতে নেই, ফল ভোগ করা যায় না। দোকানীরা ভাবছে তাদের ব্যবসা বাড়ছে, লাভ হচ্ছে। ক্রেতা ভাবছে নতুন জামা কাপড় পরে পহেলা বৈশাখ কিংবা ঈদ করতে পারবে। উভয়েই জিতছেন এমন একটি সুখানুভূতি অনুভব করছেন। ঘুণাক্ষরে ভাবছেন না এর মধ্যে দিয়ে করোনা ভাইরাস ফ্রিতে নিয়ে বাসায় ফিরছেন। নিজের পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের করোনার হুমকিতে ফেলছেন। হাসপাতালের বেডের জন্য আপনাকেও অপেক্ষায় থাকতে হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার শপিং মল, মার্কেট খোলা রাখার অনুমতি দিলেও খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেনাকাটা করতে যাওয়া যাবে না। আর যদি যেতেই হয়, তাহলে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবেন। মার্কেটে ভাইরাস সংক্রমণ হয় এমন অনেক পণ্যই রয়েছে। যেমন জামা-কাপড়, কসমেটিকস, জুতা এগুলো কিন্তু অনেকেই ধরে দেখবেন। ফলে যে কারও মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে। তিনি আরও বলেন, এ পরিস্থিতিতে যারা মার্কেটে যাবেন, তাদের অবশ্যই নিজের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

আপনি মৃত্যুর দিকে ছুটবেন নাকি নিজেকে রক্ষা করবেন- তা আপনাকেই ঠিক করতে হবে। যদি সুরক্ষা পেতে চান তাহলে ঘরে থাকুন। আর যদি আপনার জীবনের চাইতেও বৈশাখ কিংবা ঈদের পোশাক কেনা বেশি জরুরি হয়, তাহলে আপনি মার্কেটে যান।

আর যদি আপনার ওপরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেন তাহলে বিকল্প হিসেবে অনলাইনে কেনাকাটা করেন। এতে করোনার ঝুঁকি কিছুটা কম থাকতে পারে। আসুন সবাই নিজ দায়িত্বে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, নিজের সুরক্ষা নিজেই নিশ্চিত করি।

লেখক: তথ্য কর্মকর্তা, পিআইডি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :