মারধরেই মৃত্যু হয় এএসপি শিপনের, আছে রেজিস্ট্রারের সম্পৃক্ততা

প্রকাশ | ১৩ এপ্রিল ২০২১, ১২:২৭ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৫৯

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস

চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানসিক হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধরের কারণেই পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যু হয়েছে। পোস্টমর্টেম ও ভিসেরা প্রতিবেদনে এমন তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

এদিকে পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল মামুনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা। তিনিই আনিসুলকে মাইন্ড এইডে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
পুলিশ বলছে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত যে ১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, প্রাথমিক তদন্তে তারাই অভিযুক্ত। নতুন কারও নাম আসেনি। মামলায় এখন পর্যন্ত ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। দ্রুতই তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।

গত ৯ নভেম্বর মানসিক সমস্যায় ভুগে রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম। ভর্তির পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যান তিনি। পরের দিন তাঁর (আনিসুল) বাবা বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে আদাবর থানায় মামলা করেন।


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র আনিসুল করিম ৩১ বিসিএসে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। এক সন্তানের জনক আনিসুলের বাড়ি গাজীপুরে। সর্বশেষ আনিসুল করিম বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন।
ঘটনার পর আনিসুল করিমের ভাই রেজাউল করিম গণমাধ্যমে জানান, পারিবারিক ঝামেলার কারণে তার ভাই (আনিসুল) মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ঘটনার দিন ১১টার দিকে তাঁকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তারা ভর্তির ফরম পূরণ করছিলেন। ওই সময় কাউন্টার থেকে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী আনিসুলকে দোতলায় নিয়ে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা জানান- আনিসুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাকে দ্রুত হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিলে চিকিৎসক পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন।
সোমবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ফারুক মোল্লা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমরা পোস্টমর্টেম ও ভিসেরা প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। সেখানে স্পষ্ট ‘মার্ডার’ উল্লেখ আছে। নির্যাতনের কারণেই আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা প্রায় ১৪ জন সাক্ষী পেয়েছি। আরো সাক্ষী আছে। মামলায় ‘আই উইটনেস’ (প্রত্যক্ষদর্শী) আছে। করোনার কারণে তারা (প্রত্যক্ষদর্শী) বিভিন্ন জায়গায় আছেন। তাদের অনেকের মোবাইল নম্বর পাচ্ছিলাম না, কারও ঠিকানা পাচ্ছিলাম না। তাই তদন্তে অনেক বেগ পেতে হয়েছে।’
‘সাক্ষীর জন্য মামলা ক্লোজ করতে পারছিলাম না। আর একটি মামলা তদন্ত করতে গেলে অনেক সময় লাগে। তবে তদন্তের কাজ যখনই শেষ হবে আমরা প্রতিবেদন জমা দিবো।’
আসামি কতজন জানতে চাইলে তিনি জানান, মামলার পর ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত তারাই আছেন। এর মধ্যে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন জামিনে রয়েছেন।
ঘটনার সঙ্গে আব্দুল্লাহ আল মামুন জড়িত তদন্তে এমন কোনো তথ্য মিলেছে কি না জানতে চাইলে পরিদর্শক ফারুক মোল্লা বলেন, ‘'এখন পর্যন্ত যতটা পেয়েছি তাতে ‘পজেটিভ’...।’’
মামলা তদন্ত করতে গিয়ে চিকিৎসক বা অন্য কোনো জায়গা থেকে চাপ আসছে কি না এমন প্রশ্নে তদন্ত কর্মকর্তা ফারুক মোল্লা বলেন, ‘একেবারেই এমন কিছু নেই। তদন্ত তো তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কে চাপ দিলো না দিলো সেটা দেখার বিষয় না। তদন্ত তদন্তের মতোই হবে।’
পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর প্রতিবাদে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জরুরি সেবা বন্ধ করে দেয়। এসময় তারা মামুনের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন; এমনকি হাসপাতালের পরিচালক বিধান রঞ্জন রায় ও সিনিয়র চিকিৎসকদের অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করেন। গ্রেপ্তারের ছয় দিন পর এই চিকিৎসক ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় জামিনে মুক্ত হন।


জেল হাজতে আছেন— মাইন্ড এইড হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, পরিচালক ফাতেমা তুজ যোহরা ময়না, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন শেফ মাসুদ, ওয়ার্ড বয় জোবায়ের হোসেন, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মদ, সাইফুল ইসলাম পলাশ ও ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান। এছাড়া জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল মামুন জামিনে এবং পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ সিআরপিতে ভর্তি রয়েছেন।
ঘটনার পর ওই হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করে পুলিশ জানতে পারে, আনিসুল করিমকে সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে টানাহ্যাঁচড়া করে হাসপাতালটির একটি কক্ষে ঢোকানো হয়। এ সময় হাসপাতালের ছয়জন কর্মচারী মিলে তাঁকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেন। তখন নীল পোশাক পরা আরো দুজন কর্মচারী তাঁর পা চেপে ধরেন। আর মাথার দিকে থাকা দুজন কর্মচারীকে হাতের কনুই দিয়ে তাঁকে আঘাত করতে দেখা যায়। একটি নীল কাপড়ের টুকরা দিয়ে আনিসুলের হাত পেছনে বাঁধা ছিল। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদ তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এর চার মিনিট পর আনিসুলকে যখন উপুড় করা হয়, তখনই তাঁর (আনিসুল) শরীর নিস্তেজ ছিল। একজন কর্মচারী তখন তাঁর মুখে পানি ছিটালেও আনিসুল নড়াচড়া করছিলেন না। তখন কর্মচারীরা কক্ষের মেঝে পরিষ্কার করেন। সাত মিনিট পর সাদা অ্যাপ্রন পরা এক নারী কক্ষটিতে প্রবেশ করেন। ১১ মিনিটের মাথায় কক্ষটির দরজা লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৩ মিনিটের মাথায় তাঁর বুকে পাম্প করেন সাদা অ্যাপ্রন পরা ওই নারী।

(ঢাকাটাইমস/১৩এপ্রিল/এসএস/ইএস)