রিজভী ভাই ফিরে আসুন চিরচেনা রাজপথে

প্রকাশ | ১৩ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৪৮

আক্তারুজ্জামান বাচ্চু

গ্রিক দার্শনিক এরিস্টেটল বলেছেন, ‘উৎকৃষ্ট জীবন লাভের জন্য কোনো সমাজের সংগ্রামের নাম রাজনীতি।’ যদিও বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তারপরও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিতে যে ক’জন আদর্শিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন, তাদের মধ্যে অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ অন্যতম। বর্তমান অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসকের কবল থেকে মুক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল তার রাজনৈতিক জীবন। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক অত্যাচার সহ্য করেও আপেস করেননি। কিন্তু মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে আছেন রিজভী ভাই!

রাকসুর ভিপি থাকাকালীন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজশাহী রেল স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হন রিজভী আহমেদ। গুলিতে খাদ্যনালী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তখন থেকেই নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন, পায়ে ঢোকানো হয় রড, এক পা একটু ছোট হয়ে গেছে, হাঁটেন লাঠির সাহায্য নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে!  গ্রেপ্তার, ৩৫ দিন রিমান্ডে থাকাসহ নানা নির্যাতন সয়েও বিএনপির চরম দুঃসময়ে যখন কথা বলার নেতা মেলে না, তখনও দল ও দেশের পক্ষে সরকারের জনস্বার্থবিরোধী নানান ইস্যুতে সরব থাকেন রিজভী আহমেদ।

১/১১ এর সেনাশাসিত মঈনউদ্দিন-ফখরউদ্দিন সরকারের সময় তৎকালীন মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছায়াসঙ্গী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিএনপি আহুত হরতালে রিজভী ভাই দলীয় কার্যালয়েই থাকতেন। স্বেচ্ছাসেবক দলের সোহেল-সপু-বাবু কমিটির আমি তখন দপ্তরের দায়িত্বে। সারাদেশে হামলা-মামলা-গ্রেপ্তারের খবরা-খবর সংগ্রহ করে ব্রিফিংয়ের আগে সব তথ্য দেয়ার জন্য দলীয় নির্দেশে আমাকেও দলীয় কার্যালয়েই থাকতে হতো।

রিজভী ভাই রাতে তখন মরহুম মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন সাহেবের খাটে ঘুমাতেন, আমি মহাসচিবের রুমের সোফায়, বেলাল ভাই কনফারেন্স রুমের টেবিলে, আমিনুল ভাইসহ আরও দুই একজনও মাঝে মাঝে থাকতো। রিজভী ভাই রাতে খুব একটা ঘুমাতেন না, ব্যাকপেইনের জন্য আমারও ঘুমাতে কষ্ট হতো। উনি ফজরের আগেই উঠে যেতেন। ভোরবেলায়ই কিছু নেতাকর্মী চলে আসতো, আমরা রিজভী ভাইয়ের নেতৃত্বে মিছিল নিয়ে মালিবাগ মোড় ঘুরে দলীয় কার্যালয়ে নিচে এসে রিজভী ভাই বক্তব্য দিতেন, মাঝে মাঝে মহাসচিব স্যারসহ অন্য সিনিয়র নেতৃবৃন্দও আসতেন। পরবর্তী সময়ে পুলিশের বাধায় মিছিল নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত, এক পর্যায়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই আটকে দিত।

৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দলীয় কার্যালয়ের দপ্তরে গ্লাস দিয়ে আটকানো পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি বাই তিন ফুট পাঁচ ইঞ্চি রুমে আড়াই ফুট বাই চার ফুট আট ইঞ্চি খাটে আবদ্ধ জীবন, সামনে টেবিলে স্তুপাকৃত কয়েক’শ বই, ওয়াল হ্যাংগারে ঝুলানো কাপড়-চোপড়। পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিলাসিতাহীন জীবনকেই বেছে নিয়েছেন রিজভী ভাই। সারা দেশ থেকে আসা নেতা-কর্মীদের দেখা-সাক্ষাৎ, কথা শোনা, আর ম্যাডামের মুক্তির দাবিতে প্রায়ই ২০-৫০ জনের ঝটিকা মিছিল। শুরুতে স্বল্পসংখ্যক নেতা-কর্মীসহ রিজভী ভাইয়ের মিছিল নিয়ে অনেকেই সমলোচনা করতেন। কিন্তু রিজভী ভাইয়ের অদম্য ও দৃঢ়চেতা ভূমিকায় একে একে অনেকেই যুক্ত হতে থাকায় এক সময় হাজারো নেতাকর্মীর পদভারে খালেদা জিয়ার মুক্তির মিছিল রাজপথ প্রকম্পিত হতে থাকলো রিজভী ভাইয়ের নেতৃত্বে।

একবার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল। কিছু খেতে পারেন না, পেটের তীব্র ব্যথায় কুকড়ে ওঠেন। কয়েকদিন স্যালাইন চললো, অবস্থা খারাপ দেখে ডা. রফিক ভাই অ্যাম্বুলেন্স পাঠালেন, আমি ও তুষার হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।

করোনাকালীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারের নির্বাহী আদেশে বাসায় ফেরার পরদিন নিজ বাসায় ফেরেন রিজভী ভাই। নিয়মিত অফিসে আসা, মিটিং-মিছিল, নেতা-কর্মীদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ চলে সমান্তরালে। জ্বরসহ নানা অসুস্থতা নিয়েও থেমে নেই। একদিন ভাই বললেন, জ্বর নিয়েই আজকে তিন দিন সব প্রোগ্রাম করে যাচ্ছি। আমি বললাম, ভাই একটু রেস্ট নেন। উনি শুনলেন না। প্রেসক্লাবের সামনে শ্রমিক দলের প্রোগ্রাম শেষে বুকে ব্যথাসহ অসুস্থতা বোধ করায় ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। হার্টে ব্লক ধরা পড়লো। অনেকে বললেন, রিজভী ভাই আর ফিরবেন না! রিং পরানো হলো। আল্লাহর রহমতে রিজভী ভাই আবার ফিরে এলেন। দলীয় কাজ-কর্মে নিয়মিত হলেন। এরই মধ্যে তার স্ত্রী আরজুমান আরার করোনা আক্রান্ত। উনার স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠলেন।

১৬ মার্চ রিজভী ভাই করোনা আক্রান্ত হলেন। ১৭ মার্চ স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো । ১ এপ্রিল শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এখনো আইসিইউতে আছেন। প্রতিটি দিন কাটছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। প্রায়ই ডা. রফিক ভাইকে ফোন দিয়ে রিজভী ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিই, দুশ্চিন্তা যেন কিছুতেই কাটে না।

এক সাবেক ছাত্রনেতা, পরবর্তী সময়ে এমপি. হয়েছিলেন, দলীয় কার্যালয়ের রিজভী ভাইয়ের ছোট রুমে একদিন বসে গল্প করছেন। এক সময় তার হাতে থাকা রোলেক্স ঘড়ি দেখিয়ে রিজভী ভাইকে বললেন, ভাই এই রোলক্স ঘড়িটা আমার খুব সখের। দাম ৫০ লাখ টাকা! পরে রিজভী ভাই আমাকে একদিন এই গল্প বলে বললেন, শোনো আমি ছাত্র রাজনীতি করার সময় ওকে একশ বা দেড়শ টাকা দিয়েছি রাজনীতি করার জন্য। আজকে তার ৫০ লাখ টাকার শখের রোলেক্স ঘড়ি, প্রাডো গাড়ি ছাড়া চলে না। আমরা রাজনীতিটাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছি। কেউ একটা দামি জামা দিলে নিজে না পরে অন্যকে দিয়ে দিই। মানুষ কী বলবে? এই হলেন রিজভী আহমেদ।

ভাই আপনি ৫০ লাখ বা এক কোটি টাকার রোলেক্স ঘড়ি পরা, প্রাডো গাড়িতে চড়া বা ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর জন্য রাজনীতি করেন না। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য আপনার ব্রত পালন শেষ হয়নি এখনো। ফিরে আসুন রিজভী ভাই। রাজপথ যার ঠিকানা, হাসপাতালের বিছানা তাকে মানায় না।

লেখক: যুগ্ম আহ্বায়ক, ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, স্বেচ্ছাসেবক দল