শামসুজ্জামান খান ছিলেন চলন্ত বাংলাকোষ

প্রকাশ | ১৫ এপ্রিল ২০২১, ১০:১০

স্বকৃত নোমান

সেদিন সকাল থেকে ঢাকায় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। কোথাও কোথাও রাস্তা ডুবে গিয়েছিল। দুপুরে একটু সেঁক দিলে পরে ইস্কাটন থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাংলা একাডেমিতে গেলাম। শামসুজ্জামান খান তখন একাডেমির মহাপরিচালক। বসেন প্রেস ভবনের দ্বিতীয় তলায়। আগেই ফোনে কন্ট্রাক্ট করে নিয়েছিলাম। পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য তার একটি দীর্ঘ ইন্টারভিউ করব। তিনিই আসতে বলেছেন।

 

 

তার রুমে গিয়ে আমার নাম বলতেই তিনি বললেন, কী করো? আমি বললাম, লিখি।

: কী লেখো?

: উপন্যাস।

: বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ পড়েছ?

: জি, পড়েছি।

: উপন্যাসটা সম্পর্কে বলো তো দেখি কী পড়েছ?

 

আমার একটু অপমানবোধ হলো। স্বভাবে তখন একটু ত্যাদড় টাইপের ছিলাম। সবাইকে, সব কিছুকে খারিজ করে দেওয়ার প্রবণতা ছিল। আমি কি স্যারের কাছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছি? এসেছি তো তার একটি ইন্টারভিউ নিতে। তিনি কিনা উল্টো আমার ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করলেন! কিন্তু তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ, গুরুজন; তার সঙ্গে উল্টোপাল্টা কিছু বলা ঠিক হবে না। আমি ‘আনন্দমঠ’ নিয়ে বলতে শুরু করলাম। তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘জানো না, কিচ্ছু জানো না।’

 

আমার অপমানবোধ আরও বেড়ে গেল। আমি তো ঠিকঠাক বলছি। কী জানি না কিছুই বুঝলাম না। তিনি আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, এখন কী করছ? বললাম, একটি উপন্যাস লিখছি। বললেন, কী বিষয়ে? বললাম, রোহিঙ্গাদের নিয়ে। এবার তিনি রোহিঙ্গা জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমার রাগ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। আমি তখন ‘বেগানা’ লিখছি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিষয়াদি সম্পর্কে পড়ালেখা করছি, খোঁজখবর রাখছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি টেকনাফ-উখিয়ার পথে পথে। আমি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’র উদ্বৃতি দিয়ে শুরু করলাম :

 

নানা দেশী নানা লোক

শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ

আইসন্ত নৃপছায়া তল

আরবী মিসরী সামী

তুরকী হাবসী রূমী

খোরাসানী উজবেকী সকল

লাহোরী মূলতানী হিন্দি

কাশ্মিরী দক্ষিণী সিন্ধী

কামরূপী আর বঙ্গদেশী

ভূপালি কুদংসরী

কান্নাই মনল আবারি

আচি কুচি কর্ণাটক বাসী ॥

 

এটুকু পড়ার পর (সম্ভবত। কম-বেশি হতে পারে। মনে নেই) তিনি হেসে উঠলেন। বললেন, ‘বসো।’ আমি বসলাম সামনের একটি চেয়ারে। তিনি তার সহকারিকে ডেকে চা দিতে বললেন। চা খেয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা পর শুরু করলাম তার সাক্ষাৎকার নেওয়া। একটি ক্যাসেট শেষ হয়ে গেল, সাক্ষাৎকার শেষ হলো না। আরও একদিন গেলাম। দুদিনে নিলাম প্রায় তের হাজার শব্দের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। পরবর্তীকালে সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয় পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় এবং অন্তর্ভুক্ত করি আমার ‘বহুমাত্রিক আলাপ’ বইতেও।

 

২০১৩ সালের একদিন তিনি আমাকে ফোন করলেন। বাংলা একাডেমিতে যেতে বললেন। গেলাম। অনেকক্ষণ বসে রইলাম তার রুমে। আমার বিরক্তি লাগছিল। আমাকে আসতে বলে এতক্ষণ বসিয়ে রাখছেন কেন? তিনি ফ্রি হলেন। বললেন, ‘এক কাজ করো, তুমি বাংলা একাডেমিতে জয়েন করো।’ আমি কিছু না ভেবেই বললাম, ‘না স্যার, আমার পোষাবে না। আমি বড় সাংবাদিক হবো। তা ছাড়া সরকারি চাকরিতে বেতন কম। যা বেতন পাবো, তাতে তো আমার বাসা ভাড়াও হবে না।’ তিনি বললেন, ‘ওহ, তাহলে তো হবে না।’

 

২০১৫ সালে একটি বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে একুশে বইমেলায় রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমি এই সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলাম। অবিরাম লিখছি, রোদেলার স্টল খুলে দেওয়া দাবি জানাচ্ছি। বন্ধুরাসহ টিএসসিতে একটি মানববন্ধনও করলাম। রোদেলা প্রসঙ্গে একটি বিদেশি পত্রিকায় ছাপা হলো আমার ছোট্ট একটি সাক্ষাৎকার।

কয়েকটি টিভিতেও ইন্টারভিউ দিয়ে রোদেলার স্টল খুলে দেওয়ার দাবি জানালাম। লাভ হলো না, রোদেলা খুলে দেওয়া হলো না। এরই মধ্যে ‘কালকেউটের সুখ’ উপন্যাসের একটি লাইনকে কেন্দ্র করে তোপের মুখে পড়লাম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর। তারা ফেসবুকের একাধিক স্পন্সর পেজে প্রচার করে দিল আমার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর। আমার ফাঁসি দাবি করল। হুমকির পর হুমকি আসতে লাগল ফোনে। আমি ফোন বন্ধ করে দিলাম। থানায় জিডি করতে বাধ্য হলাম।

 

সে বছরের মে কি জুনের কোনো একদিন জামান স্যারের সঙ্গে দেখা। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠান হবে, সেখানে যাবেন তিনি। আমাকে দেখেই বললেন, ‘শামসুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছ, তাই না? তোমাকে আমি স্নেহ করতাম, প্রতিদান দিলে। এমনটাই হয়।’

 

আমি বললাম, ‘স্যার, আমি আপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করিনি। কোথাও আপনার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলিনি, লিখিনি। বলেছি সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। দাবি জানিয়েছি রোদেলার স্টল খুলে দেওয়ার। আমি জানি রোদেলার স্টল বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে এককভাবে বাংলা একাডেমির হাত ছিল না, ছিল মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উপর মহলের চাপ।’ স্যার বললেন, ‘তুমি আমার বিরুদ্ধে টিভিতে বলেছ, আমাকে একজন বলেছে।’ আমি বললাম, ‘আপনি একজনের কথা বিশ্বাস করলেন, আমার কথা বিশ্বাস করবেন না? ঠিক আছে, আমিও আর বিশ্বাস করাতে যাব না আপনাকে।’ স্যার হেসে উঠলেন। পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘চলো, অনুষ্ঠানে চলো।’

 

তারপর ২০১৫ সালের একদিন। আমি তখন ট্রেনে করে ফেনী থেকে ফিরছিলাম। জামান স্যার ফোন দিলেন। বললেন, ‘একাডেমিতে আমি কিছু কাজ করতে চাই, তোমাকেও কিছু কাজ দিতে চাই, করবে?’ আমি বললাম, ‘করব স্যার।’ বললেন, ‘সেক্ষেত্রে তোমার চাকরিটা ছাড়তে হবে।’ আমি বললাম, ‘না স্যার, চাকরি ছাড়ব না। আমি পাঁচটার পর কাজ করতে পারব।’ স্যার বললেন, ‘কী সব বলো! পাঁচটার পর একাডেমি খোলা থাকে!’ আমি আর কিছু বললাম না, তিনি ফোন রেখে দিলেন। আমি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলাম। এক মন বলছে একাডেমিতে জয়েন করতে, আরেক মন বলছে সাংবাদিকতায় থাকতে। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিলাম না।

 

এরই মধ্যে সংবাদপত্রের প্রতি আমার মন উঠে যেতে লাগল ক্রমে। কেন যেন পত্রপত্রিকা আর ভালো লাগছিল না। পত্রিকায় চাকরি করা তো দূর, কোনো পত্রিকায় লিখতেও ইচ্ছে করছিল না। সেসব দিনের কোনো একদিন পড়লাম আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি সাক্ষাৎকার। তিনি বলছেন, ‘তরুণ লেখকদের জন্য সংবাদপত্র আদর্শ জায়গা বটে, কিন্তু সময়মতো সংবাদপত্র থেকে সরে দাঁড়ানোটা বুদ্ধিমত্তার কাজ।’ আমার মন আরো উত্তাল হয়ে উঠল। সংবাদপত্রকে বিদায় জানানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। কিন্তু কোথায় যাব? সংবাদপত্র বাদ দিয়ে কোথায় জয়েন করব?

 

ততদিন গল্পকার মোজাফ্ফর হোসেন একাডেমিতে জয়েন করেছেন। একদিন তাকে বললাম, ‘জামান স্যার আমাকে কতবার বলেছেন জয়েন করতে, আমি করলাম না। এখন তো মনে হচ্ছে করা উচিত।’ মোজাফ্ফর বললেন, ‘আপনি স্যারের সাথে দেখা করেন।’ একদিন আমি বাংলা একাডেমিতে গেলাম স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে দেখেই তিনি মুখ গোমড়া করে রইলেন। কথা বলছেন না, বসতেও বলছেন না; যেন চিনতেই পারছেন না। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ খানিকক্ষণ পর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘বলো।’ আমি বললাম, ‘স্যরি স্যার, আমি একাডেমিতে জয়েন করতে চাই।’ বললেন, ‘মিয়া, তোমরা তো কথা শোনো না। যখন বলেছি তখন করোনি।’ আর কিছুই বললেন না তিনি। শুধু বললেন, ‘পরে আসো।’ আমি বেরিয়ে এলাম।

 

২০১৬ সালের ডিসেম্বর। সাংবাদিকতার প্রতি আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অফিসে যেতে ইচ্ছে করে না। মনটা সারাক্ষণ বিষণ্ন, অস্থির। বাসায়ও মন টেকে না। বেশিরভাগ সময় কাটাই শাহবাগে, আজিজে। মন খুব খারাপ ছিল সেদিন। দুপুরের দিকে বিক্ষপ্ত মনে ইস্কাটনের পথে হাঁটছিলাম আর সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকছিলাম। সহসা বেজে উঠল ফোন। শামসুজ্জামান খান স্যারের কল। রিসিভ করলাম। বললেন, ‘শোনো, তুমি উপন্যাস লেখো। এখন তো বুঝতেছ না, আমি না থাকলে বুঝবে। তোমাকে এতবার বললাম একাডেমিতে জয়েন করো। আমার কথা শুনলে না।’

 

জানি না কেন, আমি আপ্লুত হয়ে উঠলাম। বললাম, ‘স্যার আপনি কোথায়?’ বললেন, ‘আমি অফিসে।’ বললাম, ‘স্যার আমি তো জয়েন করতে চাই, আপনাকে সেদিন বলেছি, আপনি তো কিছুই বললেন না।’ তিনি বললেন, ‘তুমি একাডেমিতে আসতে পারবে এখন?’ বললাম, ‘আমি এক্ষুণি আসছি, স্যার।’ একটা রিকশা নিয়ে আমি ছুটে গেলাম বাংলা একাডেমিতে। সোজা ঢুকে পড়লাম স্যারের রুমে। স্যার বসতে বললেন। বসলাম। খানিক পর স্যার বললেন, ‘এস্টাবলিশমেন্টে সমীরের কাছে যাও। আজই জয়েন করো।’ আমি সেদিনই জয়েনিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলাম। রাতে আমাকে কবি সরকার আমিন ভাই ইনবক্সে লিখলেন, ‘কংগ্রাচুলেশন। আসো।’ এটুকুই। পরের দুদিন ছিল সরকারি ছুটি। তৃতীয় দিন আমিন ভাইর দপ্তরে জয়েন করে শুরু করলাম কাজ।

 

আমিন ভাই, অনু ভাই ও মোজাফ্ফর মিলে আমরা মাঝেমধ্যেই স্যারের রুমে যেতাম। স্যার যতই ব্যস্ত থাকতেন, আমাদের দেখে বলতেন, ‘বসো।’ আমরা বসতাম। স্যার চা-কফি দিতে বলতেন। খেতে খেতে আমরা শুনতাম তার কথা। এত জানতেন, এত জানতেন তিনি! রাজনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, কবিতা, ফোকলোর, বাঙালি মুসলমান, ভারতভাগ, মুক্তিযুদ্ধ...নানা বিষয়ে বলতেন।

 

আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। স্যারের সময় নষ্ট করছি ভেবে মাঝেমধ্যে আমরা উঠে যেতে চাইলে তিনি বলতেন, ‘আরো বসো।’ স্যারের সেসব কথা আমিন ভাই মাঝেমধ্যে ফেসবুক লাইভে প্রচার করতেন।

 

একবার আমরা চর কুকরি-মুকরি ভ্রমণে যাব। আমিন ভাই, অনু ভাইর সঙ্গে আমিও গেলাম স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিতে। ছুটি নিতে হয় সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক থেকে। কিন্তু আমরা পাশাপাশি স্যারের কাছ থেকেও ছুটি নিতাম। এটা আমাদের দপ্তর ছিল। তিনি যথারীতি আমাদের বসতে বলে কফি দিতে বললেন তার সহকারিকে। আমরা চর কুকরি-মুকরি যাচ্ছি শুনে তিনি বলতে শুরু করলেন ওই চরের ইতিহাস। বললেন, ‘তোমরা কি জানো বঙ্গবন্ধু ওসব অঞ্চলে গিয়েছিলেন?’ সম্ভবত আমিন ভাই বললেন, ‘না স্যার, ঠিক জানি না।’ স্যার বললেন, ‘আমি হতাশ, তোমাদের নিয়ে আমি খুবই হতাশ, তোমরা কিচ্ছু জানো না।’ এ কথাটি স্যার আমাদের প্রায়ই বলতেন। স্যারের তুলনায় আসলেই আমরা কিছু জানি না। কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার আজ এক পোস্টে শামসুজ্জামান খানকে ‘চলন্ত বাংলাকোষ’ বললেন। আসলেই তিনি তাই। বাংলাদেশ, বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতির হেন কিছু নেই যা তিনি জানতেন না।

 

বাঙালির উৎসবের দিন পয়লা বৈশাখ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঠিক এদিনেই চলে গেলেন বাঙালি সংস্কৃতির প্রখ্যাত গবেষক ‘চলন্ত বাংলাকোষ’ শ্রদ্ধেয় শামসুজ্জামান খান। অনেক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করে জানতে চাইছিলেন তার প্রয়াণের খবর। আমি তখনো খবরটি পাইনি। আমিন ভাইকে ফোন করে নিশ্চিত হলাম। তখন মনে হচ্ছিল চারদিকে কেবল শূন্যতা, শূন্যতা আর শূন্যতা। আমি এক মহাশূন্যতায় ভাসছি। শোকের ঢেউ ভাঙছিল বুকে। একের পর এক ফোন আসছিল। আমি ফোনগুলো রিসিভ করতে পারছিলাম না। করলেও ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলাম না।

 

শ্রদ্ধেয় শামসুজ্জামান খান, আপনাকে অন্তিম প্রণতি। আপনার স্মৃতি বয়ে বেড়াব। আপনার শিক্ষা লালন করব। আমৃত্যু।

মহাকালে রেখাপাত।

 

পয়লা বৈশাখ, ১৪২৮

 

লেখক: কথা সাহিত্যিক