দিশে হারাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ!

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১৪:৩৭ | প্রকাশিত : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১৪:২৩

করোনায় থেমে গেছে কাজকর্ম। বন্ধ হয়েছে উপার্জনের পথ। মহামারির প্রকোপ ঠেকাতে চলছে কঠোর লকডাউন। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে মুসলমানদের পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস রমজান। লকডাউনের এমন অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে। এতে জীবন জীবিকা চালাতে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। পেটের ক্ষুধা নিবারণই এখন তাদের জন্য দায় হয়েছে।

কথা হয় মিরপুরের রুইতন বেগম নামে এক নারীর সঙ্গে। লকডাউনের কারণে তার সংসার অনেক কষ্টে চলছে। রুইতন বেগম বলেন, গতবার যখন লকডাউন আইলো তখন আমার স্বামীর কাজকর্ম একেবারই বন্ধ হয়ে গেছিল। কোনো জায়গা থেকে সাহায্য পাইনি। তখন আমার বুড়ো স্বামী রিকশা চালাইছে। ডাল–ভাতের পয়সা হইলে বাসায় চলে আসত। এইবার খুব বিপদে আছি। বুড়ো মানুষ। চলতে পারে না। আয় না করলে খাওন কোথ্যাইকা আইব?’

তিন সন্তানের মা রোমেছা বেগম মিরপুর ১২ নম্বর সেক্টরে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তার স্বামী কুদ্দুদ মিয়া চালান রিকশা। ঢাকা শহরে টুকটাক চলে যায় তাদের সংসার। কিন্তু বছরজুড়ে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ছন্দপতন হয় তাদের জীবনে।

গতবার লকডাউনের পর আস্তে আস্তে সবকিছু খুললে তাদের সংসারও কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে। কিন্তু করোনাভাইরাস নতুন করে ভয়াবহ আকার ধারণ করায় সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনের কারণে তাদের সংসারে ফের দেখা দিয়েছে কষ্ট। এর মধ্যে লাগামহীনভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় রোমেছাদের জীবন এখন নাকাল অবস্থায়। অতিরিক্ত খরচ, সামনে ঈদ সব চিন্তা বাদ। ঘরেই খাবার জুটছে না।

এমন চিত্র শুধু রোমেছার জীবনে নয় রাজধানীর একটি বড় অংশের জীবনের প্রতিচ্ছবি এটি। খুপড়ি ঘরে, টিন সেডে ঠাসাঠাসি করে থাকা প্রতিটা মানুষের এখন এরকই অবস্থা।

যারা শুধুমাত্র রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাদের অবস্থাও একই। ঢাকা শহরে কী পরিমাণ মানুষ নিম্ন আয়ের তার কোনো জরিপ নেই। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৪ সালে একটি বস্তি শুমারি করে। ওই শুমারির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তি রয়েছে। এসব বস্তিতে মোট ঘরের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার। বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। এদের অধিকাংশই আবার রিকশা চালক। বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। এই লকডাউনে তাদের অবস্থার কথা ভাবতেই মাথা ঝিম হয়ে আসে।

গত বছরের জুনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক জরিপের তথ্য তুলে ধরে সংগঠনটির সভাপতি আবুল বারকাত বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনের ৬৬ দিনে মধ্য-মধ্যবিত্তে থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি ২ লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্তে নেমেছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তে থাকা ৫ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ দরিদ্র হয়েছেন। আর দরিদ্র থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ২ কোটি ৫৫ লাখ হতদরিদ্র হয়েছেন।

মিরপুরের শ্যাওড়াপাড়ার পাকা মসজিদের পাশে টিনশেডে থাকেন রিকশাচালক রমিজ উদ্দিন। রাতদিন রিকশা চালিয়ে প্রতিমাসে আয় হয় ১৮ হাজার টাকা। দুই ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। কিন্তু করোনা এসে সেই ছোট সংসারে এখন তুষের অনলের মতো জ্বলছে টানাপোড়েন আর সঙ্কট। রমিজ জানান, করোনার আগে ভালোভাবেই চলে যাচ্ছিল জীবন। কিন্তু করোনার শুরুর পর আয় কমে গেছে। আর লকডাউনে এখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লকডাউনের কারণে ভাড়ামারা বন্ধ প্রায়। আর বাজার সদায়ের যে দাম! চাল, ডাল, তেলের যে দাম। ছেলেমেয়ের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দেয়ায় কষ্টকর।

রমিজ বলেন, রোজার কারণে দুপুরের খাবার বেঁচে যাচ্ছে কিন্তু এভাবে কতদিন? খরচের সাথে তো তাল মেলাতে পারছি না। লাগাম টানতে পারছি না। এমন অবস্থা প্রতিটি নিম আয়ের মানুষের।

লকডাউনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে সবাই কম খাবার খাচ্ছেন। মাছ মাংস খাওয়া এক প্রকার বাদ দিয়েছেন।

সম্প্রতি এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের এক জরিপে উঠে এসেছে, করোনা মহামারি শুরুর পর মানুষের আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। বিপরীতে ব্যয় কমেছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। আর সঞ্চয় কমেছে ৬৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। করোনার কারণে ৮০ দশমিক ৬০ শতাংশ পরিবার খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে।

বর্তমানে সংসারের খরচ চালাতে হিসাব মেলাতে পারছে না নিম্ন আয়ের মানুষ। চালের দাম অনেকে বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই লাগামহীনভাবে ছুটছে চালের দাম।

কাজীপাড়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে বর্তমানে মিনিকেট ও নাজিরশাল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৬ থেকে ৭০ টাকা কেজি। মাঝারি মানের পইজাম ও লতা চালের বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬০ টাকা কেজি। মোটা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়।

এদিকে সরকারের টিসিবি পণ্যেরও দাম বেড়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক মাসে মাঝারি মানের পইজাম ও লতা চালের দাম ১ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়েছে। মোটা চালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। আর বছরের ব্যবধানে মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। বেড়েছে তেল, ডাল, চিনি, আটাসহ অন্য পণ্যেরও দাম।

এমন অবস্থায় নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের জীবন জীবিকা নিয়ে বড়ই টানা পোড়েনের মধ্যে আছে। যদি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকন বা আর না বাড়ত তবুও সংসারের হিসাব মেলাতে পারত। কিন্তু একদিনে আয় কমতে শুরু করেছে অন্যদিকে খরচ বাড়তে শুরু করেছে। সংসারের ঘানি টানতে এখন দিশেহারা এসব নিম্ন আয়ের মানুষ।

ঢাকাটাইমস/১৬এপ্রিল/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজধানী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :