‘মাহমুদ আলী রাতুল’ মামা শেষ পর্যন্ত করোনার কাছে হেরে গেলেন!

এম এম মাহবুব হাসান
 | প্রকাশিত : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১৭:১৬

মাহমুদ আলী রাতুল। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, দানবীর, মানবিক ও সদা হাস্যজ্জ্বল নিবেদিত প্রাণ। যার ফেসবুকের পোস্টগুলো ঘাটলে যে কেউ অনুপ্রাণিত হবেন, পাশাপাশি একজন পজেটিভ ও প্রগাঢ় মানবিক রাজনিতিকের আদর্শিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা লাভ করবেন।

এই অমায়িক মানুষটিকে সামাজিক সম্পর্কের জের ধরে আমি মামা ডাকতাম। গত পাঁচ বছরে এই মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক রক্তের বাধনে গড়া মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক থেকে কম কিছু ছিল না।

এই অল্প কয়েক বছরে যতবার দেখা বা কথা হয়েছে তাতে আমার ব্যক্তিগত উপলব্দি এই যে, তাঁর হৃদয়ে মননে গেঁথেছিল মানব প্রেম, দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বেশকিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও প্রায় নয় হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকারী এই মহতি মানুষটির মাঝে কোনো অহংকারের লেস ছিল না, ছিল না কোনো দাম্ভিকতা। যে গুনাবলীগুলো অনাসেই তাকে যে কারো কাছে আপন থেকে আপনতর করে ফেলতো।

তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল আস্থাশীল, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, আধুনিক ও সৃজনশীল একজন অতুলনীয় মানুষ। জেএমএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ আলী রাতুল মামা গত জাতীয় নির্বাচনে নিজ এলাকা হাতিয়া থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার টিকিট না পেয়েও তার মধ্যে কোনো কষ্ট বা ক্ষোভ দেখা যায়নি, বরং যথাসম্ভব নিজের কর্মী-সমর্থকদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন, আগের মতোই নিজ এলাকার মানুষের পাশে গিয়ে দাড়িয়েছেন। নিজের ব্যবসাকে আরো বিস্তৃত করে অধিকসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের চেষ্টায় মগ্ন ছিলেন তিনি।

আমার বড় ভাই অর্থাৎ প্রিয় ভাইজান ডিআইজি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম(বার)কে তিনি ভীষণ রকমের পছন্দ করতেন। দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা অবস্থায় সবসময় তিনি আমার, আমার পরিবার ও প্রিয় ভাইজানের কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। বেশ কয়েকবার মামা তার এলাকায় বেড়াতে যাবার আমন্ত্রণ করেছিলেন। নোয়াখালিতে বসবাসরত বেদে জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি ভালকিছু করার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু সময়, সুযোগ ও সর্বশেষ করোনা মহামারির কারণে সেই পরিকল্পনা আর সামনে এগুতে পারেনি।

আমার ভাইজান ডিআইজি হাবিবুর রহমান সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তিনি প্রায়ই ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন এবং তার নিজের ভাইয়ের করোনা পজেটিভ হওয়ার কথা জানিয়েও দোয়া চেয়েছেন। রাতুল মামার সাথে সর্বশেষ কথা হয় গত ২৬ মার্চ রাত ১০ টার দিকে এবং তখন জানান যে তিনি চট্টগ্রাম আছেন, ঢাকায় আসবেন আরো কিছুদিন পর। এরমধ্যে, যে কোনো প্রয়োজনে মামাকে যেন স্বরণ করতে ভুল না করি।

এরপর গত ২৯ মার্চ রাত ১১ টার দিকে মামার একটি মিস কল দেখে কলব্যাক করি, কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না। সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল মামাকে ফোন করলে অপরিচিত এক কন্ঠে জানানো হলো যে তিনি করোনা পজেটিভ, অবস্থা খুব খারাপ এবং তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সময়টা এমনি যে, প্রিয় ভাইজান করোনা পজেটিভ হয়ে হাসপাতালের বিছানায়, পাঞ্জেরী পাবলিকেশনের শায়ক ভাই করোনা পজেটিভ হয়ে লাইফ সাপোর্টে, এক সহকর্মীর মা ও ভাই করোনা পজেটিভ এবং ভাইকে কোনোমতে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলেও আইসিইউতে কোন বেড পাচ্ছি না।

এ সময় সিটি ব্যাংকের প্রিয় মনির ভাই এবং সিজন ভাই আমার সাথে লড়েছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। অনেক বন্ধুদের শান্তনা ও ভালোবাসায় এমন পরিস্থিতিতে শক্ত থাকতে সক্ষম হই যাদের সকলের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

কয়েকদিন পর জানতে পারলাম রাতুল মামার অবস্থা একটু উন্নতির দিকে, কিন্তু শায়ক ভাই চরম ঝুকির মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে আমার সহকর্মীর ৩২ বছরের ভাইটি জীবনের কাছে হেরে গেছে আর তার মা জীবনের সাথে তখনও লড়ে চলেছেন। শেষ পর্যন্ত মাকে ছেলের মৃত্যর সংবাদ না দিয়েই তার মৃতদেহের সৎকার্য সম্পন্ন করা হয়।

তখন সহকর্মীর চোখের জলে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিলো যা আমার পক্ষেও সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শায়ক ভাইয়ের পরিবারের সাথে কথা বলতে গেলে তাদের আকুতি শুনে নিজেকে ধরে রাখা দায় হয়ে দাড়ায়। এরই মধ্যে জানতে পারি প্রিয় ভাইজানের করোনা নেগেটিভ, শায়ক ভাইয়ের অবস্থা ভালোর দিকে, রাতুল মামার অবস্থাও কিছুটা ভালো এবং আমার সহকর্মীর ভাই চলে গেলেও মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। এতকিছুর মধ্যেও মনে বেশ স্বস্থি এলো।

রাতুল মামার পিএস জিসান সাহেবের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলে সর্বশেষ আপডেট নিতাম। এই পরশু দিনও খোঁজ নিয়ে জানলাম যে নলের মাধ্যমে খাবার দেওয়া হচ্ছে মামাকে এবং অবস্থা একটু ভালোর দিকে। প্রিয় মানুষদের সুস্থ হয়ে যাবার আশ্বাস পেলে মনের মধ্যে এক প্রকার ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়, রাতুল মামার সর্বশেষ আপডেট শুনে আমারও তাই হলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। সার্কেলের অনেকের সাথে আলাপও করেছিলাম যে রাতুল মামা সুস্থ্ হয়ে উঠছেন। কিন্তু এই বিশ্বাস ও আশা যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না তা কে জানতো। গতকাল ছিল দ্বিতীয় রমজান। অফিসের কাজ সেরে বাসায় এসে পরিবারের সাথে ইফতার সেরে বাচ্চাদের সাথে কিছু সময় পার করি। এরপর বড় ছেলে মাহিবকে নিয়ে তারাবির নামাজ আদায় করি। সাত বছরের মাহিব যদিও পুরো নামাজ পূর্ণ মনোযোগের সাথে আদায় করতে পারেনি, মাঝে শুয়ে বা বসে আমার সাথে শুধু তাল দিয়ে গেছে। কিন্তু ওর ধৈর্য্য আমাকে মুগ্ধ করেছে।

ইফতার করে এক রকমের পেট ভরপুর হয়ে গিয়েছিল তাই রাতের ডিনারে আর আগ্রহ ছিল না। কিছু সরবত খেয়ে ১১ টার মধ্যে বিছানায় চলে যাই। অল্প সময়ের মধ্যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে খুব একটি বাজে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। শত চেষ্টা করেও স্বপ্নের ঐ বাজে পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে আমার সহধর্মীনি আমাকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে ফোন হাতে তুলে দিয়ে বললো - দেখোতো রাতুল মামার নম্বর থেকে কে যেন ফোন করেছেন।

তখন রাত ১২.১৩ মি। আমার ঘুমের রেশ কাটেনি, এরমধ্যে জিসান সাহেব জানালেন- আমাদের স্যার রাত ১১.০৩ মিনিটে (১৫ এপ্রিল) ইন্তেকাল করেছেন, স্যারের গোসল সম্পন্ন করে চট্টগ্রামে তার বাবার কবরের পাশে দাফন করা হবে। মনে হলো আমি কথাগুলো শুনছি ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারলাম না যে এটা কি সত্য না যে বাজে স্বপ্নটি দেখছিলাম তারই অংশ বিশেষ। জিসান সাহেবকে আমি তেমন কিছু বলতে পারিনি, শুধু বলেছিলাম পারলে মামার একটি ছবি তুলে রাখবেন প্লিজ।

সেহরিতে উঠে মামার চলে যাবার বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হয়, মামা নেই এটি অনুভব করতে শুরু করি। সত্যিকারের ভালবাসা মানুষ যেমন পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে না, তেমনি সত্যিকারের শোকও মানুষ প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পায় না। রাতুল মামাকে হারানোর কষ্টটাকে আমি শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারছি। রক্তের সম্পর্কের বাইরেও যে কেউ প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারেন আর তারজন্য কারো হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে সেটা এই মুহূর্তে আমি ছাড়া আর কে বুঝবে।

রাতুল মামার আত্মা ওপারে শান্তিতে থাকুক, স্রষ্টা তাঁর পরিবার পরিজনকে এই অপূর্ণতা কাটিয়ে উঠার শক্তি দান করুন, আমৃত্যু এই কামনা করে যাব। আমীন।

লেখক: ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :