মাহাথির মোহাম্মদ থেকে শেখ হাসিনা: ভিশন ২০২০ থেকে রূপকল্প ২০৪১

ইলিয়াস সানি
| আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ২৩:১০ | প্রকাশিত : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ২৩:০৭

একটি দেশের উন্নয়নে সেই দেশের জনগণের অবদান যতটা থাকে, তার চাইতে দ্বিগুণ অবদান থাকে দেশটির শাসকের। শুধু একজন যোগ্য শাসকই পারেন একটি জাতির ইতিহাস সম্পূর্ণরুপে বদলে দিতে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই রাষ্ট্র কিংবা রাজার উত্থানের যত গল্প রয়েছে তা পর্যালোচনা করলে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আধুনিক যুগে ইতিহাসের প্রতিটা পাতায় রাষ্ট্র নায়কদের যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে বদলে যাওয়া রাষ্ট্রের উদাহরণ অহরহ। অবশ্যই রাষ্ট্র নায়কদের বুদ্ধিমত্তার সাথে সাধারণ জনগণের আস্থার দৃঢ়তাও যুগপৎ।

নিকট অতীতে আধুনিক মালোশিয়ার স্থপতি ও রুপকার ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ এক অনন্য সাধারণ আশীর্বাদ।

শেখ হাসিনাও সে পথে সাঁইসাঁই করে হাঁটছেন। মাহাথির ১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভিশন ২০২০ নির্ধারণ করেছিলেন। তাঁর প্রচন্ড কর্মনিষ্ঠ চরিত্র ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন সাধারণ জনগণের মধ্যে এবং ঐক্যবদ্ধ মালয়েশিয়া গঠনের স্বপ্ন জাগ্রত করেছিলেন প্রতিটি মালয়েশিয়দের অন্তরে। তাঁকেও রাজনৈতিক অস্থিরতা পেরোতে হয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে সমস্বর জবাব দিতে হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন সময় প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে। আজ শেখের বেটি যা প্রতিক্ষণে উপলব্ধি করছেন, মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১-২০০৩ পর্যন্ত তা মোকাবেলা করেই এক সময়কার দরিদ্র মালয়েশিয়াকে বিশ্বের ১৪ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ও রুপকার ড. মাহাথির বিন মুহাম্মদ ছিলেন মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রধানমন্ত্রী। এককালের দরিদ্র মালয়েশিয়াকে বিশ্বের ১৪তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তিনি তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে আশার আলো দেখিয়ে আত্মনির্ভরশীল জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিমুখী নীতি ও অন্যায় আচরণগুলোর বিভিন্ন সময় অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তীব্র সমালোচনা করেছেন মাহাথির। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংহতি ও সম্প্রীতি স্থাপন করে দৃঢ় জাতীয় ঐক্য গঠনের যে অসাধারণ দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন তা সবার জন্য শিক্ষনীয়।

১৯২৫ সালের ১০ জুলাই ব্রিটিশ অধ্যুষিত মালয়ের কেদাহ অঞ্চলের অ্যালোর সেতার নামক স্থানে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে মাহাথির জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন মাহাথির। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন দক্ষিণ ভারতের কেরালার অধিবাসী। তার পিতা মুহাম্মদ বিন ইস্কান্দার ছিলেন মালয়ের একটি ইংলিশ স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক। পিতা তাকে ধন-সম্পদ দিতে পারেন নি, কিন্তু নিজের শৃঙ্খলা, একাগ্রতা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। ঠিক যেই মন্ত্রমুগ্ধ বাণী বঙ্গবন্ধু তাঁর রক্তের যোগ্য উত্তরসূরী শেখ হাসিনা কে শিখিয়ে গিয়েছিলেন।

মাহাথির তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন মালয়ের সেবেরাং পেরেক স্কুলে। মাত্র ২০ বছর বয়সে ‘ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে’ যোগ দিয়ে মাহাথির তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন। ১৯৪৭ সালে সিঙ্গাপুরের কিং এডওয়ার্ড সেভেন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠা মাহাথির একসময় রাজনীতিতে নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলেন। ১৯৬৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে এমপি পদে নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬৯ সালে তাঁর সোজাসাপ্টা মানসিকতার জন্য রাজনীতি থেকে বহিস্কৃত হন। ৩ বছর পর রাজনীতিতে ফিরে পুনরায় ১৯৭৪ সালে পুনরায় এমপি নির্বাচিত হয়ে শিক্ষামন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রী তুন হোসেন ইতিমধ্যে অসুস্থতা হয়ে পড়লে পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং মাহাথিরকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। ১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই ৫৫ বছর বয়সে মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন মাহাথির মুহাম্মদ। এসময় দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ছিলো। দেশের সার্বিক উন্নতিকল্পে মাহাথির বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ঐক্য তৈরির জন্যে তিনি সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মালয়েশিয়াকে বদলে দেবার ক্ষেত্রে শিক্ষা হচ্ছে তার প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় শিক্ষার হার ৯০%। শিক্ষা ব্যায়ের ৯৫% সরকার বহন করছে। কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনা নিলেন। ২০২০ সাল নাগাদ মালয়েশিয়াকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে মাহাথিরের ভিশন ২০২০ স্থির করেন। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা মাহাথির নিজ দেশে গাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেন। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণ, সমুদ্র থেকে ৬,৩০০ হেক্টর জমি উদ্ধার, অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট তৈরি, একাধিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, হাইওয়ে নির্মাণসহ তার অসংখ্য উদ্যোগ সফল হয়েছে। ১৯৮২ সালে মালয়েশিয়ার জিডিপির পরিমাণ ছিলো ২৭.৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ২০০২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। উৎপাদন ও রফতানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ মালয়েশিয়া এখন পৃথিবীর অন্যতম সফল রাষ্ট্র।

এতো সফলতা সত্ত্বেও মাহাথির কে বিভিন্ন সময় বিরোধী দলসমূহের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে মাহাথির মুহাম্মদের বিরুদ্ধে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিযোগ ওঠে। পাশাপাশি সরকার সংস্কারের দাবিও অত্যন্ত জোরালো আকার ধারণ করে। একদিকে জাতিগত অসন্তোষ, অপরদিকে শরীক দলগুলোর জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার হুমকি, সব মিলিয়ে মাহাথির বিরাট সমস্যায় পতিত হন। এতোকিছুর পরেও বিভিন্ন জাতির সমন্বিত মালয়েশিয়াকে তিনি ঐক্যবদ্ধ রাখতে সফল হয়েছেন। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পশ্চিমা ও প্রাচ্যের ষড়যন্ত্র কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

আজ শেখের বেটিও তাই করে যাচ্ছেন। বিরোধী দলসমূহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে বিচার প্রার্থনা করে, ঘৃণা ছড়িয়ে শেখ হাসিনার বিশাল কর্মযজ্ঞকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে সম্প্রীতির বাংলাদেশ কে ব্যর্থ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

শেখের বেটি বহু কর্মযজ্ঞ চালিয়ে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান, মেট্রোরেল প্রকল্প সমাপ্তির পথে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চলমান, মহাসড়ক ব্যবস্থার সুফল জনগণ ভোগ করছে, মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিকীকরণ, সমুদ্র বিজয় হয়েছে, গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ শেষের পথে, আন্তর্জাতিক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ মাথা উঁচিয়ে ধরেছে, আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক বিচক্ষণতার ফসল রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, দেশব্যাপী অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত অর্থেই মাহাথির মোহাম্মদের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন।

একজন মাহাথির বিশ্বের সকল অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্যে অনুপ্রেরণা। ভান্ডারে যতটা আছে, ততটা দিয়েই কী করে উন্নয়নের প্রয়াস চালিয়ে রীতিমত সফল হওয়া যায়, তার মূর্তিমান দৃষ্টান্ত মাহাথির। তিনি মালয়েশিয়াবাসীকে শিখিয়েছেন বড় কিছু করতে, বড় কিছু চিন্তা করতে। তার উন্নয়নের মূলমন্ত্র আর অনুপ্রেরণা বুকে নিয়ে এগিয়ে চলুক প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশ।

বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের সাথের মাহাথির মোহাম্মদের মালোশিয়ার সমৃদ্ধির পথের গল্প অনেকাংশে মিলে যায়।

একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনাও লড়ে যাচ্ছেন। সাধারণ জনগণেরও এটা উপলব্ধি করা উচিত। অপশক্তি প্রেতাত্মাদের কথায় প্রভাবিত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমেই কেবল আমরা নিজেদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রুপান্তর করতে পারি।

শেখের বেটি লড়ছে, লড়বেই। মাহাথির মোহাম্মদের ভিশন ২০২০ এবং শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০৪১ একই সাফল্যের গল্প....

লেখক: সাবেক ছাত্রলীগ নেতা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :