মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিশুরা গাইতে চায়-আমরা করবো জয়

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ১৭ এপ্রিল ২০২১, ১৩:২১

‘আমরা করবো জয়’- শিশুদের জন্য একটি গান। নির্বাচিত এই গানটি স্কুলগুলোতে স্কুল শুরুর সময় গাইতে বলা হয়। গানটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একটি ইংরেজি গানের অনুবাদ গানটি। গানটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে শেখানো হয়। গানটি সকলের জীবনে অর্থপূর্ণ কিন্তু শিশুদের মুখে অপূর্ব!

উত্তরায় আমার বাসার সামনেই একটি স্কুল ছিল। প্রতিদিন সকালে আমি শিশুদের মুখে ওই গানটি শুনতাম আর মনে মনে বলতাম– ‘আমরা করবো জয় একদিন’। তখন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারাবন্দি। প্রায় প্রতিদিন একটা না একটা মামলার শুনানি চলছে। এমনকি সাবেক সেনাপ্রধান মুস্তাফিজুর রহমানকে আদালতে হাসপাতাল থেকে স্ট্রেচারে করে হাজির করা হচ্ছে। কি এক বীভৎস্য মানসিকতা তখন জেনারেলদের। তাদের টার্গেট শেখ হাসিনা। যেভাবে হোক শেখ হাসিনাকে ফাঁসাতে হবে। মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর কথা, পাকিস্তানি সামরিক সরকার যেভাবে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে বাঙালিকে দাবায় রাখতে চেষ্টা করতো। ৭ মার্চ তাই বঙ্গবন্ধু পাকস্তানিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘বাঙালিদের দাবায় রাখতে পারবা না’। সেই সময় আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার। কি দাপট উনার! তিনি নিজের ভাইকেও ফাঁসিয়ে দিলেন এক বোতল মদ রাখবার জন্য। কি পবিত্র আত্মা ওনাদের! আর বাকিরা সব অপরাধী!?

তখন জীবনের মায়া করিনি। যেমনটি করিনি ১৯৭১ সালে কিংবা ১৯৮২-১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী আন্দোলনের সময়। প্রকাশ্যেই তাই চিৎকার করে বললাম র‌্যাংগস ভবনের শ্রমিক হত্যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। পাশে বসা অধ্যাপক অবাক হয়ে তাকালেন। বললেন এখানে কিন্তু এজেন্ট আছে। প্রিয় আরেকজন বললেন দেয়ালেরও কান আছে। আমি বললাম জরুরি আইন আমি ভয় করি না। তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে বললাম কিছু একটা করেন। কিন্তু তিনিও ভীত। অবশেষে সকলে মিলে একদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে দাঁড়ালাম নেত্রী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক হারুন আর রশিদ স্যারদের জন্য। সেইদিনই মুক্তি পেলেন অধ্যাপকগণ। এরপর একেএকে মুক্তির বার্তা আমরা শুনেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৩ আগস্ট ২০০৭ প্রতিবাদ করেছিল। তার সূত্র ধরে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিবাদ ফেটে পড়ে। তখন মনে মনে গাইতাম ওই শিশুদের সঙ্গে ‘আমরা করবো জয়, একদিন’।

আজ মনে হচ্ছে আমরা যেন পরাজিত হয়ে যাচ্ছি! আমার গানে নেই সেই শক্তি। কারণ বিগত একটি বছর আমাদের শিশুরা ওই গানটি গাইতে পারে না! তারা গাইতে পারে না ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

কেবল অর্থনীতি, অর্থনীতি আর দিনমজুরের কথা বিবেচনা। আমরা নাকি ধনী হয়েছি। হ্যাঁ, হয়েছি হয়তো। কিন্তু মনের দিক থেকে অতি দরিদ্র। তাই আমরা দিনমজুদের অন্তত একদিনের জন্য রাষ্ট্র থেকে টাকা দিতে পারি না। দিতে গেলে ভয় সেগুলো গুন্ডাদের হাতে যাবে। এই আমাদের দেশ, যা আমরা পেয়েছি ২১০ বছর আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ করে।

কথাগুলো আজ আর চেপে রাখতে পারছি না কারণ- আজ অস্ট্রেলিয়া-নিউজল্যান্ড তাদের ‘অ্যানজক ডে’ সামনে রেখে ট্রাভেল বাবল তৈরি করেছে। আমরা বাংলাদেশ-ভারত ১৯৭১ সালে লড়াই করেছি। ১৭৫৭-১৯৪৭ ব্রিটিশ খেদায় আন্দোলন করেছি। তারপরেও আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি মুক্তি, যে মুক্তির স্বাদ নিউজল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ভোগ করে। আমরা বরং ভারতের প্ৰধানমন্ত্রীর আগমনে খুশি না হয়ে দেশের প্রান্তে প্রান্তে তাণ্ডব চালিয়ে জীবন বিসর্জন দিচ্ছি। আমরা দুই প্রতিবেশী পারছি না করোনাভাইরাস মুক্ত পরিবেশ গড়তে।

ভারতে প্রধানমন্ত্রী নিয়ে নানা অভিযোগ আমাদের থাকতে পারে- কিন্তু আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন এক মানব দরদী নেতা। বাঙালির প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজেকে যুদ্ধে জড়িয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে মাত্র ৯০ দিনের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছি। আমার কি সেই ভারতকে ভুলে যেতে পারি?

১৯৭১ সালে আমাদের ভাণ্ডারে ছিল না কোনো ডলার। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সেদিন ২০ কোটি ডলার আমাদের দিয়েছেন। সেই সত্য কেন আমার ভুলে যাই? শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে যেমন আমরা ভুলে গেছি তেমনি যেন ভুলে গেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান। তাই সামরিক-বেসামরিক আমলা বিগত ১২ বছর আমাদের শাসন করছে। সেজন্য হয়তো বাজারে বই বের হচ্ছে ‘গণতন্ত্র নিখোঁজ’।

অস্ট্রেলিয়ার স্কট মরিসন সরকার মাত্র এক ভোটের জোরে টিকে আছে। বাংলাদেশের মতো কিন্তু বিরোধীদল টেনে নামাতে চাইছে না। বরং করোনা মোকাবেলায় সরকারকে সহযোগিতা করছে। তেমনি বিরোধীদল নির্মূলের চেষ্টাও এখানে চলে না। আমরা দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে ছাত্রদের দিয়ে মারা হয়। আমরা শিক্ষকরা সামাজিক মর্যাদা পেতে পে স্কেল চাইলে আরও দুই ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়! আমাদের অর্থনীতির কথা বলে গরিবের হক মেরে যারা খায়, তাদের জন্য প্রাইভেটকার এবং সুসমতল রাস্তা নির্মাণ করি। আর গণপরিবহন বন্ধ থাকে। আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছি?

গরিব মরবে চিন্তা থেকে নয়, ধনীর সুবিধা কমে যাবে বলে লকডাউন দেয়া হয় না। আমরা আমাদের সমাজে রোগ পুষছি।

অস্ট্রেলিয়ার ধনীরা মনে করেছিল সরকার গরিবদের টাকা দিলে তারা লাভবান হবে না। কিন্তু জনগণ সেই চেষ্টা রুখে দেয়। গরিবদেরকে টাকা দেয়া হয়েছে- যাতে কাজে না যেয়ে ঘরে থেকে দেশকে করোনা মুক্ত করতে অবদান রাখে। অস্ট্রেলিয়া আজ সুফল পেয়েছে। আজ সরকারি হিসাব বলছে তাদের উন্নতি হবে ৪.৫% যেটা আগে ছিল অনেক কম।

সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন- গরিবদের নগদ টাকা দিন, লকডাউন কার্যকর করুন।

করোনামুক্ত বাংলাদেশে যাতে আমাদের শিশুরা আবার হাসতে খেলতে পারে। তারা যেন গাইতে পারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তারা যেন গাইতে পারে- ‘আমরা করবো জয়, একদিন, বুকের ভেতরে আছে প্রত্যয়’।

নতুবা ধর্মান্ধদের কালো হাত প্রসারিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেবে ওই কদাকার মানুষরুপী হায়েনাগুলো। বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু মানে আমার সোনার বাংলা। সেই সোনার বাংলার নাম ওরা বিশ্বমানচিত্র থেকে মুছে দিতে চায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যুগে যুগে ওরাই ভালো মানুষদের পথে কাঁটা ছড়ায়। ওরাই জাতির পিতাকে হত্যা করেছে, ওরাই ১/১১ এনেছে, ওরাই করোনামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আসল বাধা।

আজ আমাদের আরেক শিক্ষক চলে গেলেন না ফেরার দেশে। প্রতিদিন দুঃসংবাদে ভরা পত্রিকার পাতা। হুজুরদের যেখানে জায়নামাজের পাটিতে সারাক্ষণ থাকবার কথা, তখন ওনারা রিসোর্টে ফুর্তি করতে যান। এই কি তবে তাদের শিক্ষা?

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :