তারেক শামসুর রেহমান: একজন একাডেমিশিয়ানের চিরবিদায়

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
 | প্রকাশিত : ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০৮:০৬

এ যেন হঠাৎ বজ্রপাত। একজন সুস্থ তরতাজা মানুষ এভাবে নাই হয়ে যাবেন, ভাবা যায়!

অনলাইনে সংবাদটি দেখে আঁতকে উঠলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান আর নেই! উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রোজেক্টে নিজের ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। এ সময় বাসায় কেউ ছিলেন না। সকালে গৃহকর্মী এসে ডেকে সাড়া না পেয়ে সিকিউরিটিকে জানালে আশপাশের অনেকে এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করেও কোন সাড়া পাননি তার। এক পর্যায়ে পুলিশকে খবর দিলে তারা এসে দরজা ভেঙে তার লাশ উদ্ধার করে আবদ্ধ বাসা থেকে।

তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যানও ছিলেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ও বৈদেশিক নীতি নিয়ে গবেষণামূলক বেশ ক’টি গ্রন্থ রয়েছে তার। এছাড়া তুলনামূলক রাজনীতি নিয়েও তার বেশ ক’টি গ্রন্থ রয়েছে। চলতি বছর বই মেলায় তার দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নিয়মিত কলাম লিখতেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে।

তার কলাম ও টিভি টক শো অনেকেই পছন্দ করতেন নির্মোহ ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের জন্য। তার লেখায় ও বলায় একটা একাডেডমিক টাচ থাকতো সব সময়। মনে প্রাণে ছিলেন জাতীয়তাবাদী। কিন্তু পার্টিজান ছিলেন না।

তারেক শামসুর রেহমান স্যারের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল মাস দুই আগে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির রিসার্চ উইং বিএনআরসির ভার্চুয়াল টকশোতে গেস্ট করার জন্য কল দিয়েছিলাম। বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা।

বললেন, জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী তিনি।

পরে এ বিষয়ে প্রোগ্রাম করার ইচ্ছে ও তার গেস্ট হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে কথা শেষ করলাম।

এরপর আহাদ ভাইয়ের (বিএনপি নেতা খন্দকার আহাদ আহমেদ) অসুস্থতা ও চিরবিদায়, করোনা পরিস্থিতির অবনতি, সব মিলিয়ে সে অনুষ্ঠানটি আর করা হয়নি। আর কোন দিনই করা হবে না সে অনুষ্ঠান! তার আগেই চলে গেলেন তারেক শামসুর রেহমান স্যার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কাজে এলে আগেই ফোন দিতেন। কখনো না দেখা করে যেতেন না। ডেন্টাল ও মুখের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতেন আমার থেকেই। অন্য বিষয়ে চিকিৎসক দেখানোর দরকার হলেও জিজ্ঞেস করতেন কাকে দেখাবেন। আমি এ্যাপয়েনমেন্ট ঠিক করে দিতাম।

আমেরিকায় মেয়ের কাছে গেলে সেখান থেকেও কল করতেন। খোঁজ খবর নিতেন।

খুব স্নেহ করতেন আমাকে। আমার লেখা ও টকশো নিয়ে উৎসাহ দিতেন, সাহস যোগাতেন। এক সঙ্গে টকশো করেছি। গুছিয়ে যৌক্তিক কথা বলতেন।

তার এইভাবে চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কঠিন। তার অভাব অনুভব করব সব সময়।

তিনি চলে গেলেও তার চিন্তা-চেতনা রেখে গেছেন আমাদের মাঝে। তার লেখা ইরাক যুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতি, গণতন্ত্রের শত্রু-মিত্র, নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্র, উপআঞ্চলিক জোট, ট্রানজিট ইস্যু ও গ্যাস রফতানি প্রসঙ্গ, বাংলাদেশঃ রাষ্ট্র ও রাজনীতি, বাংলাদেশঃ রাজনীতির ২৫ বছর, বাংলাদেশঃ রাজনীতির চার দশক, গঙ্গার পানি চুক্তিঃ প্রেক্ষিত ও সম্ভাবনা, সোভিয়েত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর-এসব বইয়ে আমরা পাব তার চিন্তার রূপরেখা।

অত্যন্ত সজ্জন ছিলেন অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান। নির্ঝঞ্জাট জীবন যাপন পছন্দ করতেন সব সময়। সে বিবেচনা মাথায় রেখে কথা বলতেন মেপে মেপে। বিশ্লেষণে একটা একাডেমিক চিন্তার ছাপ থাকতো সব সময়। দেশের বিপক্ষে যায় এমন কোন কথা বা কাজ কখনো করেননি তিনি। কারো পারপাস সার্ভ করার কাজে নিজেকে ব্যবহৃত হতে দেননি কখনো সচেতনভাবে।

তার মৃত্যুতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে নিঃসন্দেহে। তাকে আর ফিরে পাব না সত্য, তবে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার লেখার মাধ্যমে। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসীব করুন।

লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :