একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতার মতো দুঃসময় আর কিছু নেই

শারফিন শাহ
| আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১৪:১০ | প্রকাশিত : ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১৩:৫৯

সকালে উঠে পত্রিকার কলামগুলো পড়ছিলাম। দৈনিক সমকালে প্রয়াত কবরীর স্মৃতিচারণ করে সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন লিখেছেন, কবরী তাকে হঠাৎই একদিন ফোন করলে তিনি তার বাসায় যান। তারপর নিজ হাতে ডিম, পরটা ভেজে নাশতা করান আর বলেন, তার ছেলেরা আমেরিকা-কানাডায় থাকে। তিনি একটি প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। রাজনীতি করেন বলে তার নিরাপত্তার অভাব। একটি পিস্তল কিনেছেন নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু সেটা চালাতে জানেন না।

এইটুকু পড়ে একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন নয় যে, কবরী কি পরিমাণ একাকিত্বে ভুগছিলেন! কিন্তু তার একজন চা খাওয়া, গল্প করার মানুষও জুটেনি। মিষ্টি হাসির আড়ালের বিষণ্ণ কবরীকে কেউ চিনতে পারেনি!

আরও একটি কলাম পড়ে খুব খারাপ লাগলো। দৈনিক ইত্তেফাকে সাংবাদিক ও গল্পকার প্রণব মজুমদার তার বন্ধু, সদ্য প্রয়াত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, 'সর্বশেষ মেসেঞ্জারে তার সাথে কথা বলার সময় জানালেন, প্রচণ্ড গলা ব্যথা, লকডাউনে পরীক্ষা করাতে পারছেন না। বইমেলায় শোভা প্রকাশের স্টলে আসার কথা ছিল। কলকাতা থেকে আনা ডায়াবেটিসের ওষুধের কৌটা দুটো নিয়ে আসতেও বললেন। ব্যক্তিগত জীবনে খুবই নিঃসঙ্গ ছিলেন। স্ত্রী ও কন্যা আমেরিকায় থাকতেন। এ নিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের হতাশা ছিল। তবে এ ব্যাপারে বরাবরই ছিলেন অন্তর্মুখী। একবার বললাম, আসছি একা যাব একা, একাই সবকিছু করতে হবে। স্ত্রী, সন্তান, কেউ কারো নয়। চলেন দুজনে মিলে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাই! তিনি রাজি হয়েছিলেন! তার নিকট প্রিয়জনের মমতাহীন কষ্টের সেই দীর্ঘশ্বাস অনুভব করতাম। কখনো বলতেন, আপনি কীভাবে সেটা বুঝেন প্রণব?'

একজন খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। যার লেখা আজও যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে, যার লেখা বই পড়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী চাকরি পেয়েছে, সেই মানুষের জীবন ছিল নিঃসঙ্গতার চোরাবালি!

যাযাবরের দৃষ্টিপাত বইতে পড়েছিলাম, ‘আধুনিক জীবন আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।' এই যে আবেগহীন রোবটিক জীবন, এর জন্যেই মানুষের কাছে মানুষ এত কাছে থেকেও অচেনা। নিজের জন্মদাতা পিতামাতার চেয়েও যখন বড় আমেরিকার বিলাসবহুল জীবন তখন তাতে একটা গলদ থেকেই যায়। সন্তান মানুষ করার সময় কেবল সাফল্যের গল্প শোনালে, 'লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে' এসব শুনালে সেই সন্তান বড় হয়ে আর পিতামাতার দিকে তাকাবে না, তার লক্ষ হবে কেবল সম্পদ বাড়ানো। কবরী ও তারেক স্যারের সময় এই মোহ ছিল কম। কারণ তারা নিজেরা সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন, বড় হওয়ার পর উন্নত জীবনের লোভে আমেরিকা পাড়ি দেননি, বরং দেশেই থেকেছেন। কিন্তু সন্তানদের ভেতর নিজেদের সেই মূল্যবোধ ছড়াতে পারেননি৷

এজন্যই বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ার আগে জরুরি নিজের অবস্থান বুঝে কাউকে বেছে নেওয়া। নিজের জীবন, কাজকে ভালোবাসে না, শুধু গাড়ি-বাড়ি আর সম্পদের স্বপ্নে বিভোর থাকে এমন কাউকে জীবনসঙ্গী করলে এভাবেই একা মরতে হবে। রবীন্দ্রনাথের 'মোহ' কবিতায় আছে, ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস/ওপারেতে স্বর্গসুখ আমার বিশ্বাস/নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে—কহে, যাহা কিছু সুখ সকলই ওপারে!

এই যে ওপারে গেলেই আমি সুখী হব, আমার জীবনে শান্তির ফোয়ারা নামবে, এই ধারণা পুরোপুরি ভ্রান্ত। বাবুই পাখিকে চড়ুই পাখি কটাক্ষ করে বলেছিল, তুমি থাকো কুঁড়ে ঘরে, আমি অট্টালিকায়! বাবুই হেসে বলেছিল, তুমি তো ভাই আরেকজনের পাকা বাসায় থাকো, আমি কষ্ট করে বাসা বুনে তারপর না থাকি, আমি তো কখনো কারও অট্টালিকায় যাই না, কুঁড়ে ঘরেই আমার সুখ!

কিন্তু মানুষ তো আর পাখি না। মানুষের ছয়টি রিপুর পর এবার এসেছে সপ্তম রিপু অর্থলিপ্সা। এই লিপ্সার জন্যে হেন নিষ্ঠুরতা, হেন অপকর্ম নেই যা মানুষ করে না। সকল মায়া, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা, কর্তব্য সবকিছুই যেন আজ মানুষ অর্থ দিয়ে পরিমাপ করে। পৃথিবী আজ যে করোনার মতো মৃত্যুদূতের কবলে তার পেছনেও ছিল মানুষের এই অর্থলিপ্সা। মানুষের সমাজে মানুষের মতো বাঁচতে হলে এই বিষবাষ্প থেকে বের হয়ে প্রকৃতির কাছে যেতে হবে। প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে সবুজ বৃক্ষের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে যে অনুভব করতে পারে, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ, তাকে কে অসুখী করবে?

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা

ঢাকাটাইমস/১৮এপ্রিল/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :