চট্টগ্রামে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু

আসামিদের ‘সুবিধামতো’ পেলেই ধরবে পুলিশ

প্রকাশ | ১৯ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৩৭ | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৫৯

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

চট্টগ্রামে বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল মোরশেদ চৌধুরী মৃত্যুর ঘটনা মামলায় ১২ দিনেও কোন আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। দ্রুত আসামি গ্রেপ্তার করা না হলে মামলার তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা বাদিপক্ষের।

এদিকে মামলার দায়িত্ব পাওয়া গোয়েন্দা পুলিশ- ডিবি বলছে, মামলার তদন্ত চলছে। আসামিদের আমাদের লোকশন ও সুবিধামতো জায়গায় পেলেই ধরা হবে।

চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ বলছে,অবৈধ টাকার জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাকে জীবন দিতে হয়েছে। ঘটনার নেপথ্যের যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা যেন দেশ ছাড়তে না পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

গত ৭ এপ্রিল নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ‘ব্যাংক আল ফালাহ’র চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক আবদুল মোরশেদ। পরের দিন আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে চারজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আট-দশজনকে আসামি করে পাঁচলাইশ মডেল থানায় একটি মামলা তার স্ত্রী ইশরাত জাহান।

 

অভিযুক্তরা হলেন- যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল হক চৌধুরী রাসেল, চিটাগাং চেম্বারের সাবেক দুই পরিচালক জাবেদ ইকবাল, তার ভাই পারভেজ ইকবাল এবং নাইম উদ্দিন সাকিব। তারা সকলেই জাতীয় সংসদের হুইপ চট্টগ্রামের পটিয়া আসনের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরীর ছেলে নাজমুল হক চৌধুরী ওরফে শারুনের সহযোগী।

মৃত্যুর আগে মোরশেদ চৌধুরী তার সুইসাইড নোটে লিখে যান, ‘আর পারছি না। সত্যি আর নিতে পারছি না। প্রতিদিন একবার করে মরছি। কিছু লোকের অমানুষিক প্রেশার আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ, সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমার জুমকে (মেয়ে) সবাই দেখে রেখো। আল্লাহ হাফেজ।’

মোরশেদ চৌধুরীর স্ত্রী ইশরাত জাহান জানান, ২০১৯ সালের ২৯ মে হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী ও চিটাগাং চেম্বারের সাবেক দুই পরিচালক দুটি গাড়িতে করে ১০-১২ জন যুবককে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাসভবনে প্রবেশ করেন। পারভেজ ইকবাল দলের অন্যদের নিয়ে লিফট বেয়ে ওপরে উঠে বাসার দরজা ধাক্কাতে থাকেন। এ সময় দরজা খুলতে না চাইলে লাথি মারতে থাকেন। এসময় ‘লাথি মেরে দরজা ক্র্যাক করে দেওয়া হয়’ বলে জানান ব্যাংকারের স্ত্রী।

 

তিনি বলেন, হামলার সময় ভবনটির নিচে নেমপ্লেটবিহীন গাড়িতে হুইপপুত্র শারুন ও সাবেক ছাত্রনেতা আরসাদুল আলম বাচ্চু বসা ছিলেন। আক্রমণের ভয়াবহতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আমরা পরিবার নিয়ে নিকটাত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিই। সে সময় সহযোগিতা পুলিশের চেয়ে দ্বারস্থ হয়। থানায় জিডিও করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাননি ‘মোরশেদ’। সন্তান নিয়ে আমরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছি।

সোমাবার দুপুরে সিএমপির গোয়েন্দা (উত্তর ) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সালাম কবির ঢাকাটাইমসকে বলেন, মামলার নিয়ম মেনে তদন্ত চলছে। যথা সময়ে আসামিরা গ্রেপ্তার হবেন।

এর আগে ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদ চৌধুরীর স্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করেন, ‘আমার স্বামী (আবদুল মোরশেদ চৌধুরী) তার ফুফাতো ভাই জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, পারভেজ ইকবাল চৌধুরী ও পাঁচলাইশের সৈয়দ সাকিব নাঈম উদ্দীনের কাছে থেকে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যবসাসূত্রে ২৫ কোটি টাকা নেয়। ২০১৮ সালের লভ্যাংশসহ তাদের ৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু তারপর তারা (অভিযুক্তরা) আরও টাকা দাবি করতে থাকে। এ জন্য আমার স্বামীকে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিকভাবে চাপ এবং হুমকি–ধমকি দেওয়া হয়।’

 

‘২০১৮ সালের মে মাসে আমার স্বামীকে পাঁচলাইশের এম এম টাওয়ারে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমার স্বামীর কাছে আরও ১২ কোটি টাকা বাড়তি পায় উল্লেখ করে জোরপূর্বক ‘স্ট্যাম্পে সই’ নেওয়া হয়। এসময় তারা আমার স্বামী, আমার এবং আমার মেয়ের পাসপোর্ট নিয়ে নেই। আজ পর্যন্ত তা ফেরত পাইনি। প্রতিনিয়ত আমার স্বামীকে হয়রানি, মানসিক নির্যাতন ছাড়াও বাসায় হামলা, কন্যাকে অপহরণ এবং স্বামীকে খুন করার হুমকি দেওয়া হয় অনেকবার। তাদের নির্যাতনের কারণেই মূলত আমার স্বামী আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়।’

হুইপ পুত্র শারুনের নাম মামলায় উল্লেখ কেন করেননি, এ প্রসঙ্গে ইশরাত জাহান চৌধুরী জানান, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকজন এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। নেপথ্যের ওই ব্যক্তিদের নির্দেশেই সব কিছু হয়েছে। পুলিশ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এজাহারভুক্ত আসামি পারভেজের কাছ থেকে তাদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ সহজেই পেয়ে যাবে। নিরাপত্তার কথা ভেবে তার নাম (শারুনের নাম) এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি। 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের পরিদর্শক মঈনুর রহমান। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মামলায় এখন পর্যন্ত কোন আপডেট নেই। তদন্ত কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি আসামি গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহৃত আছে।’

ভুক্তভোগী পরিবারটির অভিযোগ আসামি দেরিতে ধরার কারণে মামলার তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে এমন প্রশ্নে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘না.. না। আসামি দেরি করে ধরছি এমন তো না। আসামিকে তো আমাদের লোকশন, সুবিধা মতো আমাদের জায়গায় পেতে হবে। পাইলেই আমরা ধরে ফেলবো। এমন তো না আমরা আসামি পেয়ে গেছি কিন্তু ধরতেছি না।’ আসামি ধরতে সব রকম পদ্ধতি অবলম্বন চলছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা। বলেন, ‘আসামিকে লোকেড করার চেষ্টা করতেছি। এগুলো সবই তো কার্যক্রম, তাই না? এখানে ইচ্ছা করে আসামি ধরতে কোন দেরি করা হচ্ছে না।’

রাজনৈতিক চাপ আছে কি-না চাইলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ রকম কিছু নেই। কোন রকমের কোন চাপ নেই।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে হুইপপুত্র নাজমুল হক চৌধুরী শারুনের সংশ্লিষ্টতার খবর পাচ্ছি। তার তো ‘সুনাম’-এর কথা আগেও আমরা জেনেছি। প্রশাসনকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো, বিশিষ্টজনকে থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়াসহ আরো অনেক ‘সুনাম’ তার আছে। এমন লোকের যে অপরাধের  সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে, সে অপরাধসংক্রান্ত মামলার ভবিষ্যত্ নিয়ে দুশ্চিন্তা তো থাকেই।’

(ঢাকাটাইমস/১৯এপ্রিল/এসএস/এইচএফ)