আমার আগেই বাপ-চাচার হৃদয় জয় করে কবরী

প্রকাশ | ২০ এপ্রিল ২০২১, ১২:৪৩

শাহান সাহাবুদ্দিন

আমাদের ধ্রুপদী নায়িকা কবরীকে যতোটা না আমি নিজের চোখ দিয়ে দেখেছি তারচেয়ে ঢের দেখতে চেষ্টা করেছি আমার বাবার চোখ দিয়ে। তিনি তো আমাদের কালের নায়িকা না, অথচ আমাদের সৃজনের আকাশে তাঁর বর্ণিল আলো স্পষ্ট দেখে বড় হলাম। এটাই কবরী। প্রকৃত শিল্পী তো সব কালের, সব দেশের, পৃথিবীর বিপুলা আকাশের।

 

বাবার চোখ দিয়ে কেন বললাম? তার কারণটা হলো নায়করাজের সঙ্গে তাঁর ময়নামতি (১৯৬৯), নীল আকাশের নীচে (১৯৬৯), রংবাজ (১৯৭৩) ইত্যাদি যখন কোটি মানুষের হৃদয়ে ঝড় তুললো তখন রুপালী পর্দা নয়, পর্দার বাইরে বাস্তবের রংবাজ আমার গ্রেট বাবা বাছেদ মিঞা সাহেব। বাছেদ মিঞা সাহেবকে যারা ওই সময়ে কাছ থেকে দেখেছেন তারা বলতে পারবেন আমি এতটুকু বাড়িয়ে বলি নি।

 

আমার বাবা ষাট, সত্তর ও আশির দশকে হলে গিয়ে টিকিট কালেক্ট করার জন্য মারামারি করেন নি এমন দৃষ্টান্ত অল্পই আছে। ৭/৮ জনকে একাই ধরাশায়ী করেছেন, তাঁর শৌর্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর প্রজ্ঞা ও শরীরের উল্কাগতি দিয়ে।

 

প্রথম ও মধ্য যৌবনের রাজ্জাকের মতো দেখতে ছিলেন আমার বাবা। তবে পেশীশক্তি ছিলো রাজ্জাকের চেয়ে বহুগুণ বেশি। কিন্তু রোমান্টিসিজমে ছিলেন রাজ্জাকের মতোই। ফলে রাজ্জাক-কবরী, কিংবা ফারুক-কবরীকে মূলত আমি দেখে এসেছি আমার মহান পিতার চোখ দিয়েই।

 

তা সত্ত্বেও, আমার জন্মের অনেক আগে ১৯৬৮ সনে মুক্তি পাওয়া কবরীর সুপার ডুপার হিট ছবি, এমনকি ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট কর্তৃক ঘোষিত সেরা দশ বাংলাদেশী ছবির দশম স্থান অর্জন করা সাত ভাই চম্পা ছিলো আমার শৈশবের সেরা আবিষ্কার। মনে পড়ে, ইংলিশ প্যান্ট ও ডানলপ গ্যাঞ্জি পরে আমাদের বাড়ির নিকোনো উঠোনে অজস্র দর্শকের ভীড়ে বড় চাচা ডা. আবু তাহের (তারা ডাক্তার সাহেব) সাহেবের সাদা কালো ১৪ ইঞ্চির টিভি পর্দায় ছবিটি আমি দেখেছিলাম। ছবিটি আমার অপরিপক্ক হৃদয়ে এতই আলোড়ন তৈরি করলো যে আজও তার আবেদন এতোটুকু ফিকে হয় নি।

 

তখনো জানতাম না, আমি তো বটেই এই নায়িকা আমার বাপ চাচার হৃদয় জয় করে বসে আছে অনেক আগেই। মা-চাচীরা বড় হৃদয়ের মানুষ ছিলেন বলে সংসারে অশান্তি হয় নি।

 

তারও অনেক অনেক বছর পর তাঁর তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) দেখলাম। অভিনয় দক্ষতায় মুগ্ধ হলাম, এবং কাঁদলাম। এ ছবিটিও ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট কর্তৃক সেরা দশ বাংলাদেশি ছবির মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। অবশ্য এতে বড় ভূমিকা অদ্বৈত মল্লবর্মণের পর ঋত্বিক ঘটকের, এমনটিই মনে করি আমি। ঋত্বিক কবরীর সত্তা চিনেছিলেন। তাঁর সেরাটা বের করে আনতে পেরেছিলেন।

 

চলচ্চিত্র বোদ্ধা ও দর্শকের কাছে সেরা জুটি রাজ্জাক-কবরী হলেও আমি হেলে আছি ফারুক-কবরী জুটির অনুকূলে। এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বড় অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে সুজন সখি (১৯৭৫) ও সারেং বৌ(১৯৭৮) ছবি দুটি।

 

সারেং বৌ ছবিতে অসামান্য কন্ঠে আব্দুল জব্বারের গাওয়া এবং সারেং ফারুকের ঠোঁটে-ওরে নীল দরিয়া/ আমায় দেরে দে ছাড়িয়া।/ বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি,/ হায়রে/ কান্দে রইয়া রইয়া/কাছের মানুষ দুরে থুইয়া,/ মরি আমি ধড়-ফড়াইয়া,রে। দারুন জ্বালা দিবানিশি।।/ অন্তরে অন্তরে।

 

যখন সমুদ্রের ঢেউ ও জলরাশি মথিত করে বেজে ওঠছে, এবং ওইদিকে সারেং বউ কবরী তাঁর স্বামী বাড়ি ফিরছে, চোখে চিরকালের প্রেমের ধ্রুপদী মায়ার প্রকাশ ও মুখের কারুকাজে বিরহের ধ্রুপদী অভিব্যক্তি ঘটিয়ে সকল মেঘ কেটে গেলে বিচ্ছেদের অবসান ঘটার ভেতর দিয়ে আকাশে দেখা দেবে আশ্চর্য সোনারোদ---

 

বধুয়া তার একান্ত মানুষটিকে কাছে পাবে, বুকে লেপ্টে নেবে সবটুকু প্রেমের সরল অথচ গভীর গহন নিবেদন দিয়ে তার তো তুলনা রুপালী পর্দায় বিরল!

 

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান বিপুলভাবেই তাঁর মহিমাকে বাঙালির হৃদয়ে জারি রাখবে। হায় করোনা, শেষ পর্যন্ত আমাদের ধ্রুপদী মিষ্টি মেয়েটির হন্তারক তুমিই হ'লে! মহান আল্লাহ চিরকালের সবুজ মানুষটিকে জান্নাত দান করুন। আমিন।

 

লেখক: কবি, লেখক ও সাংবাদিক

 

ঢাকাটাইমস/২০এপ্রিল/এসকেএস