কে বড়- আলো না আঁধার?

প্রকাশ | ২১ এপ্রিল ২০২১, ১১:৫২ | আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৩

জি এম কিবরিয়া

আমি বলি, দুটোই। আঁধারের রয়েছে বিশালতা আর আলোর আছে স্বচ্ছতা। এই নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই।

কিন্তু, বাংলাদেশে কে বড় কে ছোট এই নিয়ে তর্ক নতুন কিছু নয়। যেমন, সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, ডাক্তার বড়, নাকি পুলিশ! কিংবা আমার বাবা, না তোর বাবা!

ভাগ্যিস আগে ফেসবুক ছিল না, তাই এসব জনসম্মুখে আসত না। ফলে জনগণও বিব্রত হতেন না!

তাহলে সব দোষ কি ফেসবুকের?

না। সব সিস্টেমের দোষ। আমার দেখা পৃথিবীতে, বাংলাদেশেই একমাত্র দেশ যেখানে গাড়িতে নানা রকম স্টিকার লাগানো থাকে। যেমন: পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যাংকার, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ইত্যাদি স্টিকারসহ সরকারি-বেসরকারি লোগো।

কেন? কারণ এই লোগো বা স্টিকার হয়তো তাদের চলাচলের পথকে নির্বিঘ্ন করে! ঝামেলা কমিয়ে আরাম দেয়! নয়তো কেন এত স্টিকারের ব্যবহার? আর যার কোনো স্টিকার নেই, তার কী হবে? তিনিই সাধারণ মানুষ। তাকে ঝামেলা পোহায়ে বা ম্যানেজ করেই চলতে হবে। এটাই সংস্কৃতি।

এই আজব দেশে গাড়িতে আরেকটি জিনিস লাগানো থাকে, তা হলো বাম্পার। দামি গাড়িটি যেন পিছন থেকে কেউ ধাক্কা না দেয়, সে জন্য পিছনে বাম্পারের যুক্তিটি না হয় মেনে নিলাম! কিন্তু সামনেরটি কেন? এই যে আমারও শিং আছে এবং আমিও গুঁতু দিতে পারি, সেটা প্রমাণের জন্যই সামনের বাম্পার। তাহলে আপনি শিংওয়ালা পশু?

যাই হোক, এভাবেই এদেশে জন্ম নিয়েছে একধরনের পশুত্বের সংস্কৃতি, যা রাস্তাঘাটে হরহামেশাই আপনি দেখতে পাবেন! এও দেখা যায়, এদেশের নাগরিক হয়ে রাষ্ট্রকে অস্বীকার করতে (এক বিতর্কিত শিশু বক্তাকে ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি এক জনসভায় চিৎকার করে বলছেন ‘কচুর প্রধানমন্ত্রী, কচুর রাষ্ট্রপতি, কচুর সংবিধান! আমি এসব মানি না!), অস্বীকার ও অমর্যাদা করতে দেখি রাষ্ট্রের স্থপতিকেও (হেফাজত নেতা মামুনুল হকদের দাম্ভিকভাবে বলতে দেখি "বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব")।

এসব অপসংস্কৃতি, অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতার দাম্ভিকতা কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এর কারণ রাষ্ট্রের অদূরদর্শী পলিসি। আর দেশের মানুষ এসব দেখে দেখে নিজের প্রয়োজনেই শিখে ফেলেছে এই অপসংস্কৃতির অপপ্রয়োগ; কিংবা ‘দেখি নাই বা বোবার কোনো শত্রু নেই’ থিওরিতে অভ্যস্ত হয়ে সুখে আছে!

কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে পড়ে! তদ্রূপ বাম্পার লাগানো একটি গাড়ি কীভাবে টেনে-হিঁচড়ে এক ডাক্তারের প্রাণ নিয়েছিল। সে ঘটনায়ও ফেসবুকে ঝড় উঠেছিল। পুলিশ কিছুদিন বাম্পারবিরোধী অভিযানও পরিচালনা করেছিল! কিন্তু মূল কথা হলো, হাজার মানুষ আইন না মানলে পুলিশ তা এনফোর্স করতে পারে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ আইন না মানলে, কী করবে পুলিশ? তাই তারাও হাল ছেড়ে দেয় বা দিয়েছিল; যেভাবে হাল ছেড়ে দেয় ফুটপাতে মোটরসাইকেল না চালানোর হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নের তৎপরতা!

যাক, আজকের আলোচনা এ বিষয়ে নয়। বিষয়টি ছিল, কে বড়?

দেখুন না, এদেশের নিয়মানুবর্তিতা কীভাবে ভূলুণ্ঠিত! এদেশের নাগরিকরা দেখে দেখে বড় হয়েছে যে লাইনে দাঁড়ানো বোকামি কিংবা এটি সাধারণ নাগরিকের কাজ, আমি তো বিশেষ নাগরিক! এর কারণও আছে। আপনি লাইনের যেখানে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানেই থাকবেন, এটা অনেকটাই নিশ্চিত! তাই তিনজনের লাইনেও মানুষ সিস্টেম খোঁজে! সর্বশেষ মোবাইল বের করে অমুক ভাই তমুক ভাইকে ফোন করে প্রেফারেন্স নিতে চেষ্টা করে।

মোবাইল ফোন ফুল চার্জ থাকলে যেমন গরম থাকে, তেমনি ক্ষমতার কাছাকাছি দু-একজনের নম্বর সেটায় সেভ থাকলে সে গরম আরও বেড়ে যায়! এদেশে বাস্তবতায় এটাই স্বাভাবিক! এজন্য রাস্তাঘাটে প্রায়ই শুনবেন, ‘আমি কে জানিস?’

দেখুন, জ্বর মানে অসুখ নয়, এটি অন্য রোগের উপসর্গ মাত্র। তেমনি রাস্তায় অসহিষ্ণুতা, অধৈর্য্য কিংবা দাম্ভিকতা জাতি বা জাতিরাষ্ট্রের সামাজিক ব্যাধির অন্যতম উপসর্গ।

এখন কথা হলো, এই ক্যান্সার বা ক্ষতগুলো কি রাষ্ট্র বয়ে বেড়াবে আজন্ম?

না, তা হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব নিতে হবে। নতুবা উন্নয়নের শিখরে উঠলেও বিশ্বসম্প্রদায় বলবে বাংলাদেশিরা এখনো সভ্য হয়নি! ফলে বিদেশে হোটেল ও বিমানবন্দরে চেক-আউটের সময় আপনাকে তিনবার কড়া চেকিং করেও  আড়চোখেই তাকাবে বিশ্ব।

এ থেকে মুক্তির উপায় কী?

 

. একমুখী ও এক মানের শিক্ষা

 

প্রথম প্রাইয়োরটি হিসাবে শিক্ষাব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন করতে হবে। ইতোমধ্যে গৃহীত শিশুদের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবি রাখে। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। সব স্কুলের পাঠদান পদ্ধতি ও মান এক ধরনের করতে হবে। "আমি ভালো স্কুলে পড়ি" যে অহমিকার বীজ বপন করে চলেছে শিশুমনে, তারই বহিঃপ্রকাশ ওই দিন জাতি দেখেছে রাস্তায়, "আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি, তাই আমি ডাক্তার! তুই চান্স পাসনি, তাই তুই পুলিশ!"

 

. যোগ্য শিক্ষক

 

উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার জন্য চাই নৈতিকভাবে উন্নত ও যোগ্য শিক্ষক। শিক্ষকের মান ও যোগ্যতা বৃদ্ধি করতে হলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের সবচেয়ে বেশি সম্মান, বেতন ও সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

 

. নৈতিক শিক্ষা

 

স্কুলপর্যায় থেকেই নৈতিক শিক্ষা, প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় সব শিক্ষা, যেমন- ড্রাইডিং, রান্না, মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, পাবলিক প্লেস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ভদ্রতা, নম্রতা, অগ্নি-নির্বাপন প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা, সাঁতার ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে  হবে।

 

. স্বজনপ্রীতি পরিহার

 

রাষ্ট্রের সর্বস্তরে স্বজনপ্রীতি নিরুৎসাহিত ও বন্ধ করতে হবে। সর্বাবস্থায় আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কাউকেই কোনো প্রেফারেন্স নয়। সব নাগরিকের সমান সেবা, সমান অধিকার ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেধাবীদের পদায়ন ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে।

 

. সেবাপ্রদানকারীর প্রশিক্ষণ

 

সরকারি সেবা প্রদানকারীকে সেবাগ্রহীতার প্রতি প্যাথিটিক বা সমব্যাথী হতে হবে। আপনার টেবিলের বিপরীতে যে লোকটি আছেন, তার জায়গার নিজেকে স্থাপন করে সেবা দিন, দেখবেন তিনি আপনাকে অবশ্যই সম্মান করবেন, যেমনটি লন্ডন পুলিশকে সে দেশের নাগরিকরা করে থাকে। মনে রাখবেন, আপনি এক জায়গার সেবাদাতা, বিপরীতে আরও দশ-বিশ জায়গার সেবাগ্রহীতাও বটেন। তবে সেবা প্রদানকারীকে নম্র, ভদ্র ও সমব্যাথী করতে হলে প্রতি বছর তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশেষ করে পুলিশের অভারলোড ডিউটি কমাতে হবে। তাকে যথেষ্ট বিশ্রাম, বিনোদন ও ছুটি দিতে হবে।

দেশের এই অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা বা অপসংস্কৃতি যা-ই বলুন না কেন, এটি দু-এক দিনে দূর হবার নয়। সুমিষ্ট আম খেতে হলে প্রথমে আমগাছ লাগান এবং এর যত্ন নিন। মনে রাখবেন, আমড়া গাছে আম আশা করা বোকামির নামান্তর।

লেখক: ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা।

(ঢাকাটাইমস/২১এপ্রিল/মোআ)