ভাগ্যে অন্ধবিশ্বাস ও আমাদের সংকট

প্রকাশ | ২১ এপ্রিল ২০২১, ১২:১৫ | আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২১, ১২:৪৮

নিঝুম শাহ্‌

ইদানীং চারপাশে দেখলে পুরোনো প্রবাদ মনে পড়ে যায়, ‘সর্বাঙ্গ ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা?’ প্রবাদ তো এর একদিনে প্রতিষ্ঠা পায় না, তা বহু বছরের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার শৈল্পিক প্রকাশ। আমাদের সমস্যার শেষ নেই, তাই হয়ত কেউ আর কথা বলতে চায় না। কত সমস্যার কথাই বা বলা যায়, আর কোনটা থেকেই বা শুরু করা হবে এটাই যেন কুল পাওয়া দায়। একটার সাথে আরেকটা জড়িয়ে একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা। এই ধরুন আপনি একটি বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করলেন বা কিছু বললেন, দেখবেন কতজন তার সমান্তরালের আরো অনেক সমস্যা নিয়ে হাজির হয়। ফলে আমাদের প্রত্যেকটা সমস্যাই এখন সরলীকরণের ফলে নয়া নাম ধারণ করেছে ইস্যু! একটা করে ঘটনা ঘটবে আর সকলে সেটির পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আবার সেটি সমাধান না হতে হতেই আরেকটা নতুন ইস্যু হাজির হয়। এভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নিত্যনতুন ইস্যু আর তার ক্রমাগত চাপা পড়ায় আমাদের সমস্যাগুলোও চাপা পড়ে যাচ্ছে দৈনন্দিন।

 

আমাদের কোন একটা গোড়ায় গলদ তো আছেই, যার জন্য নিত্যনতুন সমস্যা তৈরি হয় এবং কোনোটিরই সমাধান হয় না। ব্যক্তিক ভাবনায় আমার সব সময়েই মনে হয়, আসলে আমাদের ভাগ্যের ওপর অন্ধবিশ্বাসই আমাদের সকল সমস্যার মূল কারণ। খেয়াল করবেন, আমি বলিনি ভাগ্যের ওপর ‘বিশ্বাস’, আমি বলেছি ভাগ্যের উপর ‘অন্ধবিশ্বাস’। ভাগ্যের ওপর বিশ্বাসকে আমি একেবারে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিচ্ছি না। কারণ এই বিশ্বাস অনেকক্ষেত্রেই কিছু মানুষকে আশার আলো দেখায়, বিশেষ করে হতাশাগ্রস্ত ও দুর্বলচিত্তের মানুষকে। কারণ, সমাজ পরিস্থিতির চাপে পরে আমরা এমন অনেক কিছুর কবলেই পড়ি, যা আসলে আমাদের ভোগ করতে হয়। যদিও তা আমাদের পূর্বপুরুষেরই কৃতকর্মের ফল বা আমাদের নিজেদেরই। মানিকের সেই ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো আর কি। কিন্তু একথা সত্য দুর্বল চিত্তের মানুষ এই ভাগ্যের ওপর কিছু দোষ চাপিয়ে নিজের উত্তরণ পায়, ফলে একেবারেই ভাগ্যকে বাতিল করে দিতে আমি চাই না। তবে একথা  নিয়ে কোনো রকম তর্কের জায়গা নেই যে, ভাগ্যের ওপর অন্ধবিশ্বাস চরম ক্ষতিকর। সেই কবে অক্ষয়কুমার দত্ত ভাগ্যকে নাই করে দিলেন। হায়, বঙ্গবাসীর পশ্চাৎ হাঁটা শেষ আর হয় না!

 

ভাগ্যের ওপর অন্ধবিশ্বাস থেকে আমাদের  মধ্যে মেনে নেবার প্রবণতা সহজাত। পারিবারিকভাবে আমাদের এমনিতেই সত্য বলার সাহস বা প্রতিবাদ করতে শেখানোর  শিক্ষা কখনোই দিতে পারেনি। এটা যেমন সহজ সত্য তেমন এটাও সত্য যে, একইভাবে মুখ বুজে মেনে নেবার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে বরাবরই। ফলে জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আমরা যা করি সব কিছু আমাদের ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জাতিগতভাবে যুক্তির এবং মননের মুক্তির চর্চা করতে পারিনি বলেই আমরা আমাদের যাবতীয় পরাজয় নন্দ ঘোষ কপালের ওপর বর্তাতে পেরেছি। খেয়াল করলেই দেখবেন, কোনো চূড়ান্ত সফল ব্যক্তি কখনো বলেন না, তিনি ভাগ্যের জোরে সফল হয়েছেন। ভাগ্য তাদের অভিধানেই পরম আদরে লালিত হয় এবং চর্চিতও হয়, যারা আসলে জীবনে তুলনামূলকভাবে অসফল।  নিজের অপারগতাকে ঢাকতে এবং অন্যের কাঁধে তা চাপানোর জন্য ভাগ্যের চেয়ে এমন সহজ শটকার্ট রাস্তা কই পাওয়া যায়!

 

ভাগ্যের দুটো ভয়ানক সন্তান অজুহাত ও ভবিষ্যৎ। আমাদের জাতীয় জীবনের যাবতীয় সমস্যার জননীই হচ্ছেন এই ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যৎ চিন্তা পরম আদরে সকল অন্যায়-অবিচারকে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরুন আমাদের আজকের এই বাংলাদেশ। দেশটির স্বাধীনতার পূর্বে বা অব্যবহিতকাল পরে তো আমরা এর ভবিষ্যৎ নিয়ে কত জল্পনা-কল্পনাই না  করেছি। মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়কে। কিন্তু আদৌ তার বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে? হয়নি। এর অন্যতম প্রধান কারণ আমাদের এই ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা। আমরা শুধু ৫০ বছর থেকে পরিকল্পনাই করে গেছি, বাস্তবায়ন করিনি কিছুই। এত ভবিষ্যৎ নিয়ে না ভেবে আমরা যদি বর্তমানে বাস করতাম, বর্তমানে যে যেই কাজটি করছি, সেই কাজটিই সততার সাথে বা পূর্ণভাবে শেষ করতাম, তবেই পাল্টে যেত এই দেশটির চেহারা। সত্য তো এটাই আমরা এই না দেখা ভবিষ্যতের জন্য এতই আকুল ও অভ্যস্ত যে, আজকের কাজটিও আগামীকাল করতে চাই। সরকারি, বেসরকারি প্রায় সব অফিসের চিত্রই একই। এখানে কেউ আজকে কোনো কাজ করার কথা বলে না, সব আগামীকাল করা হবে।

 

মেনে নিতে নিতে আমাদের এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে আমরা জীবন যাপনেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, জীবন যে শুধু যাপনের বিষয় নয়, উদযাপনের তা ভাবতেও  শিখিনি। আমরা হয় যাপিত জীবনের ক্লেদাক্ততাতে ডুবে যাই অথবা ভবিষ্যতের সাম্পান ভাসাই। বর্তমানটা ভয়ানক বলেই হয়ত বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার এ এক দারুণ প্রতিভা আমরা অর্জন করেছি। হয় অতীতের সুখস্মৃতিতে ডুব দাও, নইলে ভবিষ্যতের সুখ কল্পনায়! কিন্তু এ যাত্রায় বর্তমানকে আমরা বরাবরই অস্বীকার করেছি অথবা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি অবলীলায়। এদেশের কবি-সাহিত্যিকদের দিকেই তাকান এর উত্তর পেয়ে যাবেন। এখানে জীবদ্দশায় কোনো শিল্পীর মূল্যায়ন করা হয় হাতে গোনা। খোঁজ নেওয়া হয় না তার কোনো সৃষ্টির, জীবনযাপনের। অথচ, এনারাই পুরস্কৃত হোন বা জাতির ‘হায় হায়’ এ পরিণত হোন যখন তাদের  মৃত্যু হয়। মরণোত্তর পুরস্কার দান বা গবেষণা তো আমাদের একটা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কঠিন কিন্তু সত্য আমরা আজ পরিণত হয়েছি মৃতপূজারীতে। জীবিত বলেই একটা খেলো, সস্তা ভাব আমাদের মধ্য থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিলেবাস দেখুন, সব পুরোনো বুলি দিয়ে ভরা। সমকালের সাথে তাদের বিরোধের কারণ নানারকম। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু সমকালকে অস্বীকার করে, বর্তমানকে উপেক্ষা করে অতীতের দিকে হাঁটা ধরলে পতন অনিবার্য। জীবিত অবস্থায় যাকে কোনো মূল্যায়ন করা হলো না, তাকে নিয়েই মৃত্যুর পর আমাদের সেকি উল্লম্ফন! অথচ জীবিত অবস্থায় মূল্যায়িত হলে হয়ত তিনি আরো মহোত্তর কিছু সৃষ্টি করে যেতে পারতেন, এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন একটা প্রজন্মকে। আমরা বর্তমানে না বেঁচে ভবিষ্যতে বাঁচি বলেই নতুন প্রজন্ম শিল্প-সাহিত্য বা মানবিক কাজ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে নিজেদের। কারণ, দিনশেষে যেটির চাহিদা বেশি সেটির দিকেই মানুষ ঝুঁকবে এটাই স্বাভাবিক। যে সমাজে তরুণ লেখক, পাঠক, বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে টিক টক আর তোষামোদকারীদের প্রাধান্য বেশি, ক্ষমতা বেশি সেখানে এমন দুর্গন্ধময় বর্তমান তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এই দুর্গন্ধ তো একদিনে তৈরি হয়নি। জীবন যাপনে মেনে নিতে নিতে ক্ষত হতে হতে ভেতরে ভেতরে এখন তাতে পচন ধরে গেছে। আপনাদের ক্ষত ঢাকার  সাধের বেনারসীটি দিয়েও এখন তাই আর দুর্গন্ধ এড়ানো যাচ্ছে না।

 

এই দুর্গন্ধময় বর্তমান তৈরির দায় একজন নাগরিকও এড়াতে পারেন না। এক বাক্যে কোনো তর্ক ছাড়াই বুঝলাম এবং মেনে নিলাম যে রাষ্ট্রের যা যা করা দরকার ছিল, তার কোনটিই রাষ্ট্র করেনি। এ বিষয়ে রাষ্ট্র পুরোপুরি ব্যর্থ। কিন্তু তারপরেও তো কেউ এ দায় নাকচ করে দিতে পারেন না। কারণ যখন আপনারা দেখলেন রাষ্ট্র পুরোপুরি ব্যর্থ, তখন আপনারা কেন সেটি পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে এলেন না? নাকি তখনো আপনারা এসব আমাদের কপালের লিখন বলে চালিয়েছেন এবং মনকে প্রবোধ দিয়েছেন? আপনারা অতীতকে নিয়ে হাহুতাশ করেছেন, গালি দিয়েছেন, ক্ষোভ ঝেড়েছেন, একে অন্যকে দোষারোপ করেছেন, করণীয়-অকরণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠিয়েছেন, নিজেদের অতীত-বর্তমান নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করেছেন; কিন্তু আপনাদের যে ভবিষ্যতের জন্য আপনারা মরিয়া হয়ে ঘুরছেন তা বিনির্মাণের জন্য বা অতীতকে পরিবর্তনের জন্য আপনারা নিজে কি করেছেন? আপনি নিজে কি করেছেন? সময় কাউকেই ক্ষমা করে না। এখনো যদি আপনারা আপনাদের এই ঘোলা জলে মাছ শিকারের অভ্যাস আর ভবিষ্যত এ করব এই আশ্বাস আর কপালের দোষ বলে ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করেন, তবে আপনাদের জন্য এই দুর্গন্ধময় বর্তমান আর আপনাদের স্বপ্নে দেখা ইউটোপিয়া জগতই আপনার প্রাপ্য।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক