রাজধানীতে দেদার লুকোচুরি বেচাকেনা

প্রকাশ | ২২ এপ্রিল ২০২১, ১১:৪১ | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২১, ১২:১৪

কাজী রফিক ও আল আমিন রাজু

চলমান লকডাউনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রধান সড়ক আর পাড়ার রাস্তাগুলোতে লোকসমাগম প্রায় স্বাভাবিক। সকাল থেকে রাত অবধি প্রায় সব দোকানপাটে চলছে কেনাবেচা। ক্রেতাদের আনাগোনা ও আর কেনাকাটার ভিড়ে মনে হওয়া কঠিন দেশে লকডাউন চলছে। তবে সদা সতর্ক দোকানিরা। পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি করে চলে তাদের এই বেচাকেনা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের তৎপরতা দেখলে খানিক সময়ের জন্য দোকানপাট বন্ধ করা হয়। তারা চলে গেলে আবার তোলা হয় দোকানের শাটার।

অনেকে আবার পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে দোকানের শাটার অর্ধেক নামিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। গ্রাহক এলে শাটার তুলে তাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ভেতরে নির্বিঘ্নে চলে কেনাবেচা। 

করোনার সংক্রমণ মোকাবেলায় প্রথম দফার লকডাউন শুরুর পরদিন থেকেই ক্রমেই দোকান খোলার সংখ্যা বাড়ছে। বুধবার দিনব্যাপী রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি, লকডাউনের কারণে তাদের অনেকের পথে বসার অবস্থা। আয়ের পথ পুরোপুরি বন্ধ হলেও খরচ ঠিকই আছে। ফলে অনৈতিক জেনেও তারা দোকান খুলতে বাধ্য হচ্ছেন।

ব্যবসায়ীদের রক্ষা করতে এরই মধ্যে দোকান মালিক সমিতি আগামী ২৬ এপ্রিল থেকে দোকান খোলার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে।

 

লকডাউনের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, খাবার দোকান ও হোটেল খোলা থাকবে সীমিত সময়। তবে ক্রেতা হোটেলে বসে খেতে পারবেন না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে খাবার কিনে নিয়ে যেতে পারবেন। এ ছাড়া জরুরি পরিষেবা ছাড়া অন্য সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকান বন্ধ থাকবে। লকডাউনের প্রথম দিন দুয়েক জায়গায় এসব নির্দেশনা কিছুটা পরিপালন হলেও এখন গোটা রাজধানীর চিত্র পুরো উল্টো।

 

রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গাবতলি, খিলক্ষেত, পুরান ঢাকা ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। সেখানকার সব কটি চায়ের দোকানে মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা চলছে। তাদের মধ্যে কোনো সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বালাই নেই।

এসব এলাকায় চায়ের দোকানের পাশাপাশি খোলা রয়েছে খাবার হোটেলসহ প্রায় সব ধরনের দোকান। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও হোটেলগুলোতে বসে মানুষের খাবার খাওয়ার চিত্রও দেখা গেছে। খাবার হোটেল ও চায়ের দোকানের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা হার্ডওয়ারের দোকান, সেলুন, ওয়ার্কশপ, স-মিল খোলা রাখা হচ্ছে দিনভর।

 

মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির আল আমিন হোটেল, সোসাইটি ক্যাফেতে বসে খাবার খাওয়ার সুযোগ রয়েছে দিনভর। চায়ের দোকান ও খাবার হোটেলে মানুষের আড্ডা কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, হাতিরঘাট এলাকায়ও দেখা গেছে।

 

স্থানীয়রা জানান, পুলিশের টহল গাড়ি বা জনপ্রতিনিধিদের আনাগোনা দেখলে খানিক সময়ের জন্য দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়। আবার কিছুক্ষণ পরেই খোলা হয় দোকান।

মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং এলাকার একজন সেলুন মালিকের কাছে দোকান খোলা রাখার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘দোকান খোলা না রাখলে চলব কীভাবে? কাউন্সিলর আইসা বইলা গেছে দোকান বন্ধ করতে। তখন বন্ধ করছিলাম। সে কি আমাদের খাবার দিয়া যাইব?’

 

এদিকে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে বিরিয়ানির দোকান, অটোমোবাইলসহ সব দোকানপাট খোলা রয়েছে। ক্যাম্পের ভেতরে উর্দুভাষীদের অবাধ চলাচলের পাশাপাশি সাধারণ বাঙালিরাও প্রতিদিন ভিড় করছেন ক্যাম্পটিতে। একই অবস্থা মিরপুরের উর্দুভাষী ক্যাম্পগুলোর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মানুষকে বোঝাতে গেলে তারা অভাব দেখায়। আমার ওয়ার্ডের প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার পরিবার আছে যারা দরিদ্র। তাদের মধ্যে বিহারীরাও আছে। তাদের করোনার বিষয়ে সতর্ক করতে গেলেই তারা ত্রাণ চায়। আমরা একদিক থেকে দোকান বন্ধ করে দিয়ে আসি। আমরা চলে আসলে আবার খুলে ফেলে।‘

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে জানান, দোকান বন্ধ থাকার কারণে ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে। পুঁজি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তবুও বর্তমান পরিস্থিতিকে মেনে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কষ্ট হচ্ছে, খুবই কষ্ট হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই।’

 

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বা লুকিয়ে দোকান খোলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দোকান লুকিয়ে খোলার কোনো সুযোগ নেই। বুঝতে হবে জীবন-জীবিকা দুইটাই প্রয়োজন। জীবন আগে, তারপর জীবিকা। আমরা যদি এই মুহূর্তে এটা করি, তাহলে সংক্রমণটা আমার হবে, আমার পরিবারের হবে। আর হওয়ার পরে বুঝা যায় এটার ইফেক্টটা কী!’

স্থানীয় দোকানপাটের পাশাপাশি মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের হ্যান্ডিক্রাফট কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের কাজ চলছে প্রতিদিন। যেখানে সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি বলতে কিছুই নেই। চালু রয়েছে মাল্টিপারপাস প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিদিনই এসব প্রতিষ্ঠান ঋণ প্রদান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা-বাড়ি থেকে ঋণের অর্থ সংগ্রহ করছে।

এছাড়া প্রতিদিন বিকেলে রাজধানীকে ঘিরে থাকা নদীর পাড়ে মানুষের ভিড় জমে মাত্রাতিরিক্ত। ইফতারির আয়োজন থেকে শুরু করে ইফতারের পর নানান আয়োজনে তুরাগ নদীর ঢাকা উদ্যান, গাবতলী, বিরুলিয়া, চটবাড়ি এলাকা হয়ে ওঠে জমজমাট।

এদিকে পুরান ঢাকার সদরঘাট, বাংলাবাজার ও নবাবপুর এলাকায় দেখা গেছে ভিন্ন রকম দৃশ্য। গার্মেন্টসের পণ্য ও গাড়ির যন্ত্রাংশ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানের শাটার নামিয়ে বিক্রি হচ্ছে পণ্য। ব্যবসায়ী ও দোকানের কর্মচারীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে টহল পুলিশকে পাহারা দিতে দেখা গেছে। মাঝে গ্রাহক আসলে দোকান খুলে দ্রুত মালামাল বুঝিয়ে দিয়ে আবার শাটার বন্ধ করে রাখতে দেখা গেছে।

 

এ যেন নামেই লকডাউন

 

প্রথমে বেশ কড়াকড়ি থাকলেও রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে এখন ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। মূল সড়ক ছাড়া অলিগলির দোকানপাট একদিকে যেমন খোলা, তেমনি সড়কে যানবাহনের চাপও বেড়েছে। আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর বারবার জোর দেয়া হলেও সেদিকে যেন কারো কোনো তোয়াক্কা নেই। অনেকে মাস্ক ছাড়াই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, চাঁন মিয়া হাউজিং, মোহাম্মাদিয়া হাউজিং সোসাইটি, আদাবর, পিসিকালচার হাউজিংসহ বেশ কিছু এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা অনেক দোকানপাট খোলা।

এসব এলাকায় ইলেকট্রিক, হার্ডওয়ার, লন্ড্রি, সেলুন, কাপড়ের, চায়ের দোকানসহ নানান ধরনের দোকান খোলা রয়েছে। অন্য সাধারণ সময়ের মতো তারা সকাল-সন্ধ্যা দোকান খুলে বসছেন।

 

কলেজ শিক্ষার্থী তানভীরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এভাবে সব খোলা রেখে এটা কোন ধরনের লকডাউন হচ্ছে? এতে কোনো উপকার হচ্ছে বলে মনে হয় না। প্রশাসনকে কঠোর হওয়া দরকার।’

(ঢাকাটাইমস/২২এপ্রিল/মোআ)