বৌদ্দিদের তাঁবুতে একদিন...

প্রকাশ | ২২ এপ্রিল ২০২১, ১২:৩৮ | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২১, ১২:৫২

নাজমুল হাসান নাঈম বিশ্বাস

ইংরেজিতে যাদের জিপসি বলে, আমাদের অঞ্চলে তাদের বলে বৌদ্দি। দশ বছর আগে আমি একদিন বৌদ্দিদের তাঁবুতে গিয়েছিলাম। ওরা গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়, গান গেয়ে ভিক্ষা করে, দাঁতের পোকা সারায়, এবং গঞ্জিকা বিক্রি করে। গ্রাম বা শহরের পাশে ফাঁকা জায়গায় ওরা তাঁবু ফেলে, একসাথে লাইন ধরে কয়েকটি তাঁবু থাকে। এরকম একটি তাঁবুতে আমার বন্ধু সুনন্দ আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল এক মহিলার কাছে যিনি কালোজাদু জানতেন।

আমি তখন আমার এক সহপাঠিনীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি, কৈশোরের সর্বগ্রাসী প্রেম, ব্লেড দিয়ে হাত কেটেছি দুবার কিন্তু প্রেমাস্পদ কিছুতেই আমাকে পাত্তা দিবে না বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসে আছে। নন্দ বলেছিলো মহিলাটি জাদু করে মেয়েটিকে বশে এনে দিতে পারবে। আমি এসব কালো জাদু কখনো বিশ্বাস করিনি, শৈশব পার হবার পরে আমি বুঝে গিয়েছিলাম জাদু মূলত হাতের কারসাজি, মন্ত্রতন্ত্র কোনো কাজে আসে না, পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।

তবুও প্রেম মানুষকে অন্ধ করে। স্কুলের বিজ্ঞান ক্লাসে স্যার বলেছিলেন যে ডেমোক্রিটাসের অনেক আগে পরমাণুর ধারণা দিয়েছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী কণাদ, কণাদের আসল নাম জানা যায় না, খাদ্যকণা ভিক্ষা করতেন বলে তাকে প্রাচীন বই-পুস্তকে ডাকা হয়েছে কণাদ নামে। কণাদ রাস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, তিনি কারো বাড়িতে যেতেন না, পথচারী কেউ দয়াপরবশ হয়ে তাকে কিছু দিলে তিনি খেতেন নতুবা না খেয়ে থাকতেন, তার ধ্যান ছিল গাছের নিচে বসে মহাবিশ্বের গঠন নিয়ে চিন্তা করা, একটি জীবন তিনি এভাবে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। প্রেম আমাকে ভাবালো এই মহিলাও তো হতে পারেন কণাদের মতো, তিনি হয়তো এমন কিছু ভেবে বের করেছেন যা আমাদের জ্ঞানসীমার বাইরে।

সেই তাঁবুতে যে মহিলাটি আমার সাথে কথা বলেছিলেন তার পরনে ছিলো নীল শাড়ি, হলুদ ফিতেয় বাঁধা ছিল তার চুল। পদ্মাবতীর ঠোঁটের বর্ণনা দিতে গিয়ে আলাওল লিখেছিলেন তাম্বুল রাতুল হইলো অধর পরশে, তাম্বুল মানে পান। এই মহিলা পান খাচ্ছিলেন, এখন তার পান খাওয়া ঠোঁটের কথা মনে করতে গিয়ে আমার শুধু আলাওলের উপমা মনে আসে। আমি অচেনা লোকদের সাথে কথা বলাতে খুব অপটু, প্রিয়জনেরা যদিও আমায় বাচাল বলে জানে।

মহিলাটাকে ঘটনা বলতে গিয়ে আমি ঘেমে যাচ্ছিলাম, আমার ইতস্তত ভাব দেখে নন্দ আমাকে সাহায্য করছিলো। দুজনে মিলে ঘটনাটিকে মোটামুটি একটি আকার দেবার পরে তিনি একশো টাকা চাইলেন, দিলাম, বই কেনার নাম করে একশো তিরিশ টাকা মেরে দিয়েছিলাম এই ঘটনার আগেরদিন। তারপর মহিলাটি আমায় একটি তাবিজ দিলেন, বললেন প্রেমাস্পদের বাড়ির সামনে কোনো পেয়ারা গাছে যেন তাবিজটি ঝুলিয়ে রাখি।

এরপর সুনন্দ ওর সমস্যার কথা বললো, পাড়ার এক ভাবির পেট বেঁধে গিয়েছে, ভাবির দাবি বাচ্চা সুনন্দের, ভাবিটি এখন তার হাত ধরে পালিয়ে যেতে চায়, সে কিছুতেই পালাতে চায় না, সে মুক্তি চায়। আমি ততক্ষণে তাঁবুর সামনে কাঠের পিঁড়িতে বসে সহজ হতে শুরু করেছি। আমি মহিলাটিকে একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করলাম, তিনি হ্যাঁ, হু, না এসব এক শব্দে উত্তর দিচ্ছিলেন, নন্দের কাছ থেকে তিনি দুইশো টাকা নিলেন। নন্দ সিগারেট খেতো, কিন্তু রাস্তাঘাটে সিগারেট টানার বয়স তার তখনো হতে অনেক দেরি, সে বললো তাঁবুতে যেহেতু এসেছে সে এখানে বসে একটি সিগারেট খেয়ে যাবে।

আমি তাঁবুতে ঢুকার দরজায় বসে রইলাম, ভেতরে বৌদ্দি মহিলা, বাইরে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে নন্দ সিগারেট টানতে লাগলো। সে মহিলা তখন বলতে শুরু করলেন তার স্বামীকে তিনি ছেড়ে এসেছেন ষোলো বছর আগে, সংসার তার ভালো লাগতো না। সংসার ভালো লাগতো না তার স্বামীরও, স্বামীটি গরুর ঘাস কাটতে গিয়ে খেতের আইলে বসে বাঁশি বাজাতে বসতো, ঘাস কাটার কথা আর মনে থাকতো না তার। তবে বাউল হবার সাহস স্বামীটি করে উঠতে পারেনি, মহিলাটি পেরেছিলেন। একমাত্র সন্তানকে দাদীর হাতে ফেলে এরকম একটি বৌদ্দি দলের সঙ্গে তিনি অচেনা পথে পা বাড়ান, এরপর দুবার তিনি দল পাল্টেছেন।

এখন তিনটে তাঁবুতে আট জন মানুষ নিয়ে তাদের দল, দলে ছয় জন পুরুষ দুই জন নারী, যে পুরুষ যেদিন তার সাথে ঘুমাতে চায় তিনি তার সাথে ঘুমান। প্রতিদিন অন্তত দুজন পুরুষ তাকে পেতে চায়, তারা প্রতিযোগিতা করে, তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়, এটা তিনি উপভোগ করেন। যখন যার বাহুতে আবদ্ধ থাকেন ফিসফিস করে তার কানে বলেন মনে মনে তিনি তাকেই কামনা করেছেন। এই ছলনা তার বড় ভালো লাগে, মূলত তিনি নির্দিষ্ট কাউকে কামনা করেন না, তবে এক পুরুষ বেশিদিন ভালো লাগে না তার।

পুরুষ হলো তরকারির মতো, নারী হলো ভাত, একই তরকারির সাথে প্রতিদিন মাখামাখি করলে ভাত পানসে হয়ে যায়। এই কথাটি বলে তিনি হাসলেন, সম্ভবত আমার প্রেম নিয়ে ব্যঙ্গ করলেন, কিছুক্ষণ আগে আমি তাকে বলেছিলাম প্রেমাস্পদ ছাড়া অন্য নারীকে ছোঁবার আগে আমি আকণ্ঠ বিষ পান করবো। ছোটবেলা থেকে শুনেছি সুখের পর দুঃখ আসে, যারা হেসেখেলে জীবন কাটায় তাদের মৃত্যু হয় করুণ। আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম মারা গেলে আপনার জানাজা কে পড়াবে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমি তাকে খারাপ মহিলা ভাবতে শুরু করেছি, তখন তিনি বলেছিলেন মৃত মানুষের কোনো জানাজা দরকার নেই, জানাজা দরকার মৃত মানুষের পরিবারের, পরিবার তিনি ফেলে এসেছেন।

ওখান থেকে বের হয়ে এসে আমি নন্দকে বলেছিলাম মহিলাটি তো বারোভাতারি, নন্দ বললো ঠিক সংখ্যাটা তার অর্ধেক, ছয়ভাতারি। দুজনে হাসলাম, আমি ওকে বললাম তাবিজটা ফেলেদে, টাকাগুলো গচ্চা। নন্দ বললো মাগি ছয়ভাতারি হলেও মন্ত্র কাজ করবে।

মন্ত্র কাজ করেনি, মেয়েটি একদিন আমার কপালে হাত রেখে বলেছিলো জ্বর নেই, মেয়েটি কখনো এরচেয়ে নিকটতর হলো না। মেয়েটি এখন কোন পুতুলঘরে শাড়ি পরে নেচে বেড়ায় আমি তার খোঁজ রাখিনি, আমি জেনেছি প্রেম একাবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী কুসংস্কার। কিন্তু ওই জিপসি মহিলাকে আমি মনে রেখেছি। তিনি পুতুলজীবনের মুখে থুথু মেরে মানুষের জীবনকে বরণ করতে পেরেছিলেন, নিয়মের বেড়াজালে বিষাদকে যাপন করার পরিবর্তে তিনি সুখ খুঁজে নিতে পেরেছিলেন নিষিদ্ধ আলিঙ্গনে। উনি যেখানেই থাকুন হাসি যেন তার রাতুল ঠোঁটে লেগে থাকে।

বৈকুণ্ঠের স্মৃতিকথা।

লেখক: সাংস্কৃতিককর্মী ও শিক্ষার্থী, জাবি

ঢাকাটাইমস/২২এপ্রিল/এসকেএস