বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে আমাদের দায়বদ্ধতা ও নৈতিক কর্তব্যবোধ

প্রকাশ | ২২ এপ্রিল ২০২১, ২১:৪২

স্মৃতি শারমিন জলি

আজ 'বিশ্ব ধরিত্রী দিবস'। প্রতিবছর ২২ এপ্রিল মহাসমারোহে এ দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়ে থাকে। যেখানে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রই ধরিত্রীর সকল সংকট দূরীকরণের প্রত্যাশা নিয়ে দিবসটিকে পালন করে থাকে। ১৯৬৯ সালে পরিবেশ-প্রকৃতির প্রতি মানুষের বিশেষ সচেতনতা, পরিবেশ দূষণ রোধ এবং প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রায় ২০ লাখ মানুষের সক্রিয় আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৭০ সালে এ দিবসটির সূত্রপাত। ১৯৬৯ সালে সানফ্রান্সিসকোতে ইউনেস্কো সম্মেলনে শান্তিকর্মী জন ম্যাককনেল ধরিত্রীর প্রতি সচেতনতার লক্ষে এবং বিশ্বমাতার সম্মানে একটি দিন উৎসর্গ করার প্রস্তাব করলে উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিন হিসেবে ১৯৭০ সালের ২১ মার্চ প্রথম দিবসটি পালিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২২ এপ্রিল, ১৯৭০ সালে পরিবেশগত শিক্ষামূলক দিন হিসেবে একটি আলাদা ধরিত্রী দিবসের অবতারণা করেন যুক্তরাষ্ট্র সেনেটর গেলর্ড নেলসন।

আমাদের বসবাসযোগ্য এ ধরিত্রীর বয়স আনুমানিক ৪৫০ কোটি বছর। ধরিত্রীর এই দীর্ঘ পরিক্রমায় ধরিত্রী যেমন সুগঠিত হয়েছে তেমন ধারণ করেছে প্রাণ,অপ্রাণসহ নানা প্রাকৃতিক উপাদান। যেখানে মানবজাতির আগমন অনেক পরে। ধরিত্রী নিজস্ব নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই দেখা দেয় বিপর্যয়। ধরিত্রীর এ শৃঙ্খল তার প্রত্যেকটি উপাদানকে একটি একক নিয়মে আবদ্ধ করে রাখে। তাই যখন ধরিত্রীর এই শৃঙ্খলে কোনোভাবে আঘাত আসে তখন তার প্রভাব প্রকৃতির প্রত্যেকটি উপাদানের ওপর পরে।

আমরা মানবজাতি প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন হওয়ার সুবিধার্থে পরিবেশ-প্রকৃতি তথা ধরিত্রীকে নিজেদের মতো করে ব্যবহারের সু্যোগটা আমরাই নিয়ে থাকি। কিন্তু পরিবেশের প্রতি আমাদের প্রভুত্বমূলক আচরণ, প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার, উন্নত জীবনযাপন করতে গিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্যে আঘাত এসবই ধরিত্রীর আজকের বিপর্যয়ের কারণ।

মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতির সবকিছু একপাক্ষিকভাবে ভোগ করে আসছে যার কারণে আমরা আমাদের চাহিদার সীমানাকে নির্দিষ্ট করতে ভুলে গেছি। আমাদের ভোগ-বিলাসপূর্ণ অফুরন্ত চাহিদা আর উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বনভূমির ধ্বংস, কলকারখানা বৃদ্ধি, গ্রিনহাউজ গ্যাসসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক গ্যাসের নিঃসরণ, ক্ষতিকারক কেমিক্যালের ব্যবহার প্রভৃতিসহ নানা ধ্বংসাত্মক কাজে আমরা লিপ্ত আছি। যার আবশ্যিক ফল হিসেবে আজকের মাটি,পানি,বায়ু দূষণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, মানুষের দেহে করোনার মতো আরও অনেক নিরাময় অযোগ্য ভয়াবহ রোগের আক্রমণ। এসবই আমাদের মানবসমাজের কৃতকর্মের প্রতি আঙুল দেখিয়ে দিয়ে যায়। তাই আমরা কোনোভাবেই কেবল দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে আমাদের দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে  যেতে পারি না।

১৮০০ সালের আগ পর্যন্ত ধরিত্রী এবং ধরিত্রীর সংকট নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর না থাকলেও পৃথিবীর বিরূপ আচরণ মানুষকে পৃথিবী নিয়ে নতুন করে ভাবনায় ফেলে দেয়। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাই পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে নানা আন্দোলন। এরকম কিছু আন্দোলনের মধ্যে সত্তরের দশকে নরওয়েজিয়ান দার্শনিক আর্ন নায়েস ও জর্জ সেশনের নেতৃত্বে 'গভীর বাস্তুবিদ্যা' আন্দোলন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মেধা পটেকারের নেতৃত্বে 'নর্দমা বাঁচাও',জঙ্গল বাঁচাও' আন্দোলন, পক্ষী বিশারদ সেলিম আলির নেতৃত্বে 'সাইলেন্ট ভ্যালি' আন্দোলন, অতি সম্প্রতি পরিবেশ দূষণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে ১৬ বছর বয়সী স্কুল পড়ুয়া সুইডিশ বালিকা গ্রেটা থুনবার্গের 'ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার' আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এসবই ধরিত্রী রক্ষা করার একেকটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।

এসকল বিচ্ছিন্ন আন্দোলন ছাড়াও ধরিত্রী বাঁচাতে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্নসময় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু নৈতিক কর্তব্যবোধের জায়গা থেকে যায়। এ জায়গা থেকে আমরাকে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছি তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের মতো আমরা মানবজাতি একটি স্বতন্ত্র উপাদান। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত হবে না প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান যেমন অন্য প্রাণী, বৃক্ষরাজি,নদ-নদী,পাহাড়-পর্বত থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র বালিকণা পর্যন্ত কোনো উপাদানকে নিজেদের সীমিত প্রয়োজনের বাইরে বিলাসী জীবনযাপনের জন্য নির্বিচারে ব্যবহার করা।

আমাদের উচিত প্রকৃতির প্রত্যেকটি উপাদানকে সম্মান করা। যেহেতু জীবনধারণে আমাদেরকে পরিবেশ-প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয় সেহেতু প্রকৃতিকে রক্ষা করা আমাদের নিজেদের জীবন রক্ষার সাথেই সমানুপাতিক। তাই আমাদের উচিত হবে আরও সচেতন হওয়া। অন্তত আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বিপর্যয়মুক্ত পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধের স্থান থেকে আজকের ধরিত্রী দিবসের শপথ হোক - প্রকৃতিকে বাঁচানোর মধ্য দিয়ে মানব অস্তিত্বের সংকটকে উত্তরণ।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, দর্শন বিভাগ,  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়