জনপ্রশাসনে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার মানসিকতা প্রতিষ্ঠা জরুরি

মো. আক্তারুজ্জামান
 | প্রকাশিত : ২৪ এপ্রিল ২০২১, ১৭:১৫

রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের জনপ্রশাসনে নিযুক্ত করা হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কর্মচারী। ব্রিটিশ শাসন ও এর মডেলকে অনুসরণের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও পশ্চিমাদের অনুসরণে একটি আধা-পশ্চিমা ও ত্রুটিপূর্ণ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। আধা-পশ্চিমা বলছি এ কারণে যে আমরা না অনুসরণ করতে পেরেছি সংশোধিত ব্রিটিশ মডেল আবার না পেরেছি নিজেদের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে সময় উপযোগী জনপ্রশাসনের মডেল তৈরি করতে।

যা হোক, অন্যান্য রাষ্ট্রের ন্যায় বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থাও সাজানো হয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সরকারি কর্মচারীদের সমন্বয়ে। সেখানে বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিস যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন পেশার নন-ক্যাডার সদস্য। শ্রমের বিভাজন ও বিশেষীকরণের নীতি অনুসরণেই এটা করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুচরুভাবে বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতার পৃথকীকরণ শুধু নয়, সাথে প্রয়োজন হয় সমন্বয় এবং ভারসাম্য রক্ষা। কিন্তু নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে বৈচিত্র্যময় শ্রেণি-পেশার গণকর্মচারীদের মধ্যে এই সমন্বয় আর ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় জনপ্রশাসনে এক পেশার কর্মচারীদের প্রতি অন্য পেশার কর্মচারীদের আস্থার সংকট। জনপ্রশাসনে এই আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে দশকের পর দশক ধরে পুঞ্জিভূত বিভিন্ন ধরনের প্রকারের ক্ষোভ, বঞ্চনা আর হতাশা থেকে।

এই ক্ষোভ, বঞ্চনা, হতাশাকে দুটি মাত্রা থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। প্রথমত, এক ক্যাডারের সাথে অন্য ক্যাডারের বৈষম্য, যেটাকে বলা হয়ে থাকে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য এবং দ্বিতীয়ত, ক্যাডার এবং নন-ক্যাডারের বৈষম্য।

প্রথমেই যদি আন্তঃক্যাডারের চিত্র বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করি তাহলে দেখতে পাব, একটি ক্যাডারের সর্বাত্মকবাদী আকাঙ্ক্ষার কাছে প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যরা পুরোপুরি অসহায়। একই পদ্ধতির মাধ্যমে কর্ম কমিশনের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে একই দিনে কেউ নিযুক্ত হয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারে, কেউ স্বাস্থ্য ক্যাডারে, কেউবা কৃষি, শিক্ষা বা অন্যান্য ক্যাডারে। কিন্তু হতাশা, বঞ্চনা, ক্ষোভের জন্ম হয় ঠিক কর্মজীবনের প্রথম দিন থেকেই। একটি বাস্তব চিত্র উপস্থাপন করলে দেখতে পাব কী ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে একটি ক্যাডারের সাথে আরেকটি ক্যাডারের।

মিস্টার কুণ্ডু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের মেধাবী ছাত্র। তিনি ২০১২ সালের জুন মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে সাকুল্যে ১৮ হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করেন। যোগদানের দিন তার চোখে-মুখে দেখেছি শিক্ষকতার মহান ব্রতকে ধারণ করার একটি চকচকে জ্যোতি। বাড়ি থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে চাকরি করেছেন, নিজের বাবাকে শেষবারের জন্য দেখতে পারেননি স্থানিক দূরত্বের কারণে। তবুও ক্লাসের প্রতি তার আন্তরিকতা, অধ্যবসায়, শিক্ষার্থীদের প্রতি তার ভালোবাসার এতটুকু ঘাটতি দেখিনি দিন, মাস, বছরের পর বছর পেরিয়ে। একই ব্যাচে তার সাথে যোগদানকৃত প্রশাসন, পুলিশ, কৃষি বা অন্য ক্যাডারের সদস্যরা যখন ঠিক ৫ বছরে পদোন্নতি পেলেন, তখন থেকে মিস্টার কুণ্ডু ভুগতে থাকেন সামাজিক মর্যাদার সংকটে। অন্য ক্যাডারের সাথে আর্থিক বৈষম্য সাথে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য তো রয়েছেই। তার সাথে যোগদানকৃত বিভিন্ন ক্যাডারের সদস্যরা যখন সপ্তম থেকে পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতির প্রত্যাশা নিয়ে কর্মস্থলে প্রবেশ করেন, সেই সময়ে তিনি প্রায় এক দশক ধরে নবম গ্রেডে চাকরি করার হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন।

এই শিক্ষা ক্যাডার সদস্যটির মনোবল না ভাঙার, হতাশা জন্ম না নেয়ার, সামাজিক মর্যাদার জন্য আক্ষেপ তৈরি না হওয়ার কোনো উপায় পৃথিবীর কোনো মনোবিশেষজ্ঞের জানা আছে কি না আমরা জানি না।

শুধু শিক্ষা আর প্রশাসন ক্যাডার নয়, দুই একটি ক্যাডার বাদে অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে সামগ্রিক চিত্রটি একই রকম। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন সদস্যের সাথে পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারের যে অপ্রীতিকর ঘটনা, তার পেছনে এই বঞ্চনা, ক্ষোভ, হতাশা অন্যতম কারণ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন।

এতক্ষণ আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের একটি বাস্তব চিত্র বিশ্লেষণ করলাম। আমরা যদি ক্যাডার আর নন-ক্যাডারের ভেতর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তাহলে সেই চিত্রটি হবে আরো ভয়াবহ। বাংলাদেশ সচিবালয়ে নন-ক্যাডার পদে কিছুদিন চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে অধিকাংশ ক্যাডার সদস্য নন-ক্যাডার সদস্যদের কর্মস্থলে দ্বিতীয় শ্রেণির জীব বলেও ভাবতে চান না। এটা হচ্ছে মানসিকতার, আচরণের বহিঃপ্রকাশের দিক থেকে বিশ্লেষণ।

আবার সরকারি চাকরির বিভিন্ন সুযোগ আর সামাজিক মর্যাদার বিষয় বিশ্লেষণ করতে গেলে বৈষম্য ছাড়া ভাবনায় অন্য কিছু স্থান পাবে না।

ফলশ্রুতিতে জনপ্রশাসনে আস্থার সংকটের পালে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা যা একটি সার্ভিস থেকে আরেকটি সার্ভিসের দূরত্ব বাড়িয়েই চলেছে। জননীতি এবং রাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষকরা এটিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে মনে করেন।

আদতে জনপ্রশাসনের অধিকাংশ সদস্যকে বঞ্চনার শিকারে পরিণত করে গুটিকয়েক সদস্যকে সর্বভূক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করলে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সেটি মারাত্মক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আশার কথা হলো, বাংলাদেশের রাষ্ট্রশক্তির প্রধান নির্বাহী আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণ বিষয়ে বারবার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। আর হতাশার কথা হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বারবার নির্দেশনাকেও নীতি বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ কখনই কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেননি।

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নেয়ার। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে প্রস্তাব করা হচ্ছে কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠনের যা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসৃত নীতি ছিল। মোটকথা জাতির এগিয়ে যাওয়ার এই দিনে জনপ্রশাসনে পারস্পারিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতামূলক মানসিকতার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সেজন্য প্রশাসনিক সংস্কার বা কৃত্যপেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠন বা অন্য যা-ই হোক না কেন, দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে কাগজে কলমে টেকসই উন্নয়ন দেখতে পেলেও প্রয়োজনের সময় সেটিকে তাসের ঘরের মতো মনে হবে।

লেখক: বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সদস্য ও

পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :