যেমন আছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ

প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০২১, ১৩:৪২ | আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২১, ১৩:৪৮

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস

নিভৃতেই যাপন করছেন নব্বয়োর্ধ্ব জীবন। নিজের ফ্ল্যাটে উদয়াস্ত সময় কাটে তাঁর। ধীরপায়ে হাঁটেন। খবরের কাগজ পড়েন। মন চাইলে দু-একটি বইয়ের পাতা উল্টে দেখেন ঝাপসা চোখে। এমনিতেও লোকজনকে খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ দিতেন না, এখন এই করোনাকালে একেবারেই না। জীবনসায়াহ্নের দিনগুলো এভাবেই কাটছে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানিত পদে দায়িত্ব পালন করা মানুষটি দীর্ঘদিন ধরেই লোকচক্ষুর আড়ালে আছেন। ছোট ছেলে, ছেলেবউ, নাতি আর ব্যক্তিগত সহকারী ছাড়া আর কেউ তাঁর ছায়াটিও দেখতে পায় না এখন।

গুলশানের গ্র্যান্ড প্রেসিডেন্ট কনকর্ডের ব্যবস্থাপক আব্দুল মোতালিব। পাঁচ বছর ধরে আছেন এখানে। তিনিও খুব একটা দেখেননি সাবেক প্রেসিডেন্টকে। যাও দু-একবার তাঁকে দেখেছেন, লিফট থেকে গাড়িতে ওঠার চলতি পথে।

মোতালিব  বলেন, ‘এখানে আমার পাঁচ বছরের সময়ে স্যারকে দু-একবার দেখেছি চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে যেতে। লিফটে নেমে গাড়ি। আবার গাড়ি থেকে লিফটের দুয়ার। এর মাঝে একঝলক দেখা।’

ছয়তলা ভবনটির দোতলায় থাকেন সাহাবুদ্দিন আহমদ। আঙুল উঁচিয়ে পশ্চিমের জানালাটি দেখিয়ে মোতালেব বললেন, ‘ওই যে ওই ফ্ল্যাটেই থাকেন স্যার। কিন্তু তাঁকে জানালাতেও দেখিনি কখনো।’

২০১৩ সাল থেকে গ্র্যান্ড প্রেসিডেন্ট কনকর্ডে ছোট ছেলে সোহেল আহমদের সঙ্গে বসবাস করছেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। সহধর্মিণী আনোয়ারা আহমদ গত ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। সেই থেকে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন ৯২ বছর বয়সী সাহাবুদ্দীন আহমদ।   

মোতালেব বলেন, ‘মাঝেমধ্যে স্যারের সহকারী নিচে আসলে তার সঙ্গে কথা হয়। তার মুখেই শোনা, স্যার সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। পত্রিকা পড়েন। বইপত্র মন চাইলে পড়েন। না চাইলে না।’

দেখা-সাক্ষাতের জন্য খুব একটা কেউ আসেন না গ্র্যান্ড প্রেসিডেন্টে। যারা আসেন, তারা সাবেক রাষ্ট্রপতির দেখা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান। আত্মীয়-স্বজনরাও দেখা পান না কখনো-সখনো। তাই এই পথে সাবেক প্রধান বিচারপতির খোঁজে কেউ তেমন আসেন না।

করোনা মহামারি দেশে আসার আগে দু-একজন মাঝেমধ্যে সকাল-বিকাল আসতেন। কিন্তু করোনার পর কারো ছায়াটি নেই।

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধক টিকা নিয়েছেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। গত শনিবার আব্দুল মোতালেব জানান, ‘দশ কি বারো দিন আগে সিএমএইচ থেকে একটি মেডিকেল টিম এসে তাঁকে টিকা দিয়ে গেছে। টিকা নেওয়ার পর কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শুনিনি। বয়সের কারণে কিছু রোগ-শোক ছাড়া এমনিতে সুস্থই আছেন তিনি।’

ছয়তলা গ্র্যান্ড প্রেসিডেন্ট কনকর্ডের ২০টি ফ্ল্যাটের আটটি পেয়েছেন তিনি। বাকি ১২টি কনকর্ডের। নিজের আটটি ফ্ল্যাট ছেলেমেয়েদের ভাগ করে দিয়েছেন। নিজের নামে রেখেছেন একটি। সেটিতেই থাকেন তিনি।

সাবেক এই প্রধান বিচারপতির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বড় মেয়ে অধ্যাপক ড. সিতারা পারভিন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ওই দুর্ঘটনায় তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে শাহানা স্মিথের স্বামী গুরুতর আহত হয়ে পরের বছর মারা যান। শাহানা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছেন। ছোট মেয়ে সামিয়া পারভীন একজন স্থপতি। তিনি বাস করেন যুক্তরাজ্যে। বড় ছেলে শিবলী আহমদ একজন পরিবেশ প্রকৌশলী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছিলেন। বর্তমানে দেশেই আছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে পারছেন না।

সব সময়ের জন্য ছায়াসঙ্গী হিসেবে একজন ব্যক্তিগত সহকারী আছেন সাহাবুদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তার সহায়তায় ধীরে ধীরে হাঁটেন তিনি। কখনো নিজে নিজেই হাঁটতে পারেন। মোতালেব জানান, তার পরিবারের কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই। নিষেধ আছে। তাছাড়া করোনায় তাদের বাসা থেকে কেউ নামেন না বলেও জানান তিনি।

সাহাবুদ্দীন আহমদ নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পেমই গ্রামে ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা তালুকদার রেসাত আহমদ ভূঁইয়া ছিলেন একজন খ্যাতনামা সমাজসেবক।

গুলশানের ভবনটির তদারকির দায়িত্বে থাকা আবদুল মোতালেবের গ্রামের বাড়িও নেত্রকোনার আটপাড়ায়। তবে কেন্দুয়াতেও তাঁর আসা-যাওয়া আছে। বললেন, ‘স্যার খুব সৎ মানুষ। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। গ্রামের বাড়িতে যা সহায়-সম্পদ আছে, সেগুলো অন্য লোকজন ভোগ-দখল করে আছে। তিনি এসব নিয়ে কখনো কিছু বলেননি।’   

সাহাবুদ্দীন আহমদের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন

সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর কর্মজীবনে প্রথমে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালের জুন মাসে তাঁকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয়। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারক পদে উন্নীত করা হয়।

১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দীন আহমদকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করা হয়। বিচারপতি হিসেবে তাঁর দেওয়া বহুসংখ্যক রায় প্রশংসিত। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তাঁর দেওয়া রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত।

১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তৎকালীন সরকার তাঁর সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ১৯৭৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। ওই দিনই রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করে উপরাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর ফলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সরকারপ্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার নেতৃত্বে দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়, যা দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা পায়।

সাহাবুদ্দীন আহমদের চাহিদা অনুসারে দেশের সংবিধানের এগারোতম সংশোধনীটি আনা হয়। এর ফলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পরও তিনি ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে সুপ্রিম কোর্টে ফিরে যান এবং ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

সাহাবুদ্দীন আহমদ আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ওই বছর ক্ষমতায় এসে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নেন।

(ঢাকাটাইমস/২৬এপ্রিল/মোআ)