মডেল তিন্নি হত্যাকাণ্ডের বিচার কতদূর?

প্রকাশ | ২৮ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৫৮ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১, ১৫:২৫

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস

প্রায় ১৯ বছর আগে মডেল কন্যা সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নির চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনো সম্পন্ন হয়নি। মামলাটির প্রধান আসামি সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির কোনো হদিস না পাওয়ায় ঝুলে আছে বিচারকাজ। ইন্টারপোল পরপর তিন বার অভির ব্যাপারে রেড নোটিশ জারি করলেও সংস্থাটি বাংলাদেশ পুলিশকে তার সম্পর্কে জানাতে পারেনি কোনো তথ্য। আলোচিত মামলাটির বিচারকাজ চলছে ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ আদালতে। মামলাটি এখন সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। বিচারকাজ কবে শেষ হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেন না।

মামলার নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদীর  ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে মডেল তিন্নির লাশ পাওয়া যায়। পরদিন অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন কেরানীগঞ্জ বর্তমান মডেল থানার তৎকালীন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. সফি উদ্দিন। এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কাইয়ুম আলী সরদার। এরপর নিহত তিন্নির লাশের ছবি পত্রিকায় ছাপা হলে সুজন নামে নিহতের এক আত্মীয় লাশটি মডেলকন্যা তিন্নির বলে শনাক্ত করেন। পরে মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে ২০০২ সালের ২৪ নভেম্বর তদন্তভার সিআইডিতে ন্যস্ত হয়। আর তদন্তের দায়িত্ব পান তৎকালীন সিআইডির পরিদর্শক ফজলুর রহমান।

এরপর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পরিদর্শক সুজাউল হক, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ এবং এএসপি মোজাম্মেল হক। সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তিন্নি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে ৪১ জনকে সাক্ষী করা হয়। এছাড়াও এই মামলায় ২২টি আলামত জব্দ করা হয়।

পুলিশি তদন্তে প্রাথমিকভাবে জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভি অভিযুক্ত হলেও পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। আর অভির অনুপস্থিতিতেই ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ তিন্নি হত্যা ও মরদেহ গুমসংক্রান্ত মামলায় অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

আদালত সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল সর্বশেষ তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম আদালতে আংশিক সাক্ষ্য দিয়েছেন। এরপর একই বছরের ২৫ আগস্ট মামলাটির কার্যক্রম উচ্চ আদালত স্থগিত করেন। নিহত তিন্নির বাবা বিদেশ থেকে এসে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু মাঝপথে মামলাটি স্থগিত হয়ে যাওয়ায় তিনি আবার বিদেশে চলে গেছেন।

গোলাম ফারুক অভি পলাতক থাকা অবস্থায় উচ্চ আদালতে আবেদনের মাধ্যমে মামলাটি স্থগিত করা হয়েছিল বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে মামলাটির স্থগিতাদেশ বাতিল হয়েছে। যদিও এসংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র আদালতে না যাওয়ায় মামলাটির কার্যক্রম অনেকটা থমকে গেছে।

এ ব্যাপারে ঢাকার সপ্তম জেলা দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর কামাল হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এখন কোর্ট বন্ধ থাকায় আমি মামলাটির অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না।’

 

তিন্নি হত্যা যেভাবে

 

আদালত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে খুন হন তিন্নি। এর আগে ৬ নভেম্বর তিন্নিকে তার স্বামী সাক্কাত হোসেন পিয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করেন অভি। তিন্নিও তাকে তালাক দেন। ওই দিনই পিয়ালকে তার দেড় বছর বয়সী কন্যাসন্তানসহ রাজধানীর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর বিয়ে করার জন্য অভিকে চাপ দিতে থাকেন তিন্নি। একপর্যায়ে তিন্নি বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেন।

১০ নভেম্বর রাতে মাথায় আঘাত করে তিন্নিকে হত্যা করা হয়। এরপর গুমের উদ্দেশ্যে ওই রাতে বুড়িগঙ্গার ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ওপর থেকে নদীতে ফেলে দেয়া হয় লাশ। কিন্তু পানিতে নয়, লাশটি পড়ে পিলারের উচুঁ অংশে। পরদিন সকালে লাশ ঘিরে জমে উৎসুক জনতার ভিড়।

কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ লাশ উদ্ধার করে সুরতহালের পর ময়নাতদন্ত করে। মর্গে চার দিন রাখার পর ১৫ নভেম্বর অজ্ঞাত হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় তিন্নিকে।

এদিকে তিন্নি চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হারানো ডায়েরি করেন। লাশ উদ্ধারের দিন একই থানায় একটি হত্যা মামলা করেন থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. শফি উদ্দিন। অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের আসামি করা হয় মামলায়।

পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছোট্ট সংবাদের সূত্র ধরে তিন্নির স্বজনরা আঞ্জুমানে মুফিদুলে যান। ছবি দেখে চিনতে পারেন সেটা তাদের প্রিয় তিন্নির লাশ। এরপর ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।

 

কে এই অভি, আছেন কোথায়?

 

গোলাম ফারুক অভির উত্থান ঘটে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। ছাত্র হিসেবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। এসএসসি এবং এইচএসসিতে বোর্ড পর্যায়ে মেধার সাক্ষর রাখেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলন ঠেকাতে এরশাদের নেক নজর পান অভি। ওই সময় অপহরণ ও মুক্তিপণ এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে তিনি তিনি গ্রেপ্তার হন। তবে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের চরম পর্যায়ে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তাকে কারাগার থেকে ছাড়া হয়। আর ছাড়া পেয়েই পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। এত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরও তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের হাত ধরে ১৯৯৬ সালে বরিশাল-২ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

চাঞ্চল্যকর তিন্নি হত্যা মামলার ফেরারি আসামি গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল)। তবে দীর্ঘ ১৪ বছরেও তার কোনো সন্ধান বা কোনো ধরনের তথ্য ইন্টারপোল বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তরকে জানাতে পারেনি।

বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করার পর প্রতি পাঁচ বছর পরপর পুনরায় আবেদন করতে হয়। এরপর পুলিশ সদরদপ্তর থেকে অভির বিরুদ্ধে আবেদন করা হলে ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি পুনরায় ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। কিন্তু ইন্টারপোল তার ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। পুনরায় ওই রেড নোটিশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়। এরপর ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি পুনরায় আবেদন করা হলে একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ইন্টারপোল অভির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে। এটি ২০২২ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

দীর্ঘ ১৪ বছরেও ইন্টারপোল গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের তথ্য বাংলাদেশ পুলিশের কাছে দিতে না পারলেও চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার ফেরারি আসামি গোলাম ফারুক তার নিজ এলাকায় ঈদের জামাতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে আসছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তবে অভি এই মুহূর্তে কোন দেশে আছেন সেটা কেউ বলছে পারছেন না।

এ ব্যাপারে পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (ইন্টারপোল) মহিউল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অভির ব্যাপারে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।’

(ঢাকাটাইমস/২৮এপ্রিল/এএ/জেবি)