রাজনীতিমুক্ত কওমি মাদ্রাসা: একাল-সেকাল

প্রকাশ | ২৮ এপ্রিল ২০২১, ১১:৩৯ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১, ১১:৪৯

লিয়াকত আমিনী

আরবি প্রবাদ আছে, `কুল্লু শাইয়িন ইয়ারজিয়ু ইলা আসলিহি‘- সব তার মূলের দিকে ফিরে যায়। দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোও সাবেক বৈশিষ্ট্যের দিকে ফিরে যাচ্ছে। রাজনীতিমুক্ত হতে যাচ্ছে এসব মাদ্রাসা। কওমি শিক্ষা বোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের স্থায়ী কমিটি এমন ঘোষণা দিয়েছে। রবিবার যাত্রাবাড়ীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদ্রাসায় এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা ছিল রাজনীতিমুক্ত। তখন মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র কেউ রাজনীতি করতেন না। কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত প্রমাণ হলে বহিষ্কার করা হতো।

মূলত, ১৯৮১ সাল থেকে কওমি মাদ্রাসাগুলো রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে। তখন থেকে লালবাগ মাদ্রাসা হয়ে ওঠে খেলাফত আন্দোলনের অঘোষিত প্রধান কার্যালয়। রাজনীতিমুক্ত দেশের অন্যতম শীর্ষ মাদ্রাসাটি হয়ে ওঠে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সেই সঙ্গে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো হয়ে ওঠে খেলাফত আন্দোলনের দুর্গ।

হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পরও শায়খুল হাদিস আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জীবদ্দশায় ইসলামি রাজনীতির নেতৃত্ব ছিল ঢাকার আলেমদের হাতে। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে মোর্চা করে হাফেজ্জী হুজুরের জামাতা মুফতি ফজলুল হক আমিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন।

শায়খুল হাদিস আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনী পরপারে চলে যাওয়ায় সারা দেশের আলেম সমাজের নেতৃত্বে আসেন চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শাহ আহমদ শফী (রহ.)। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে তার নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।

২০১১ সালে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ ঘোষিত হওয়ার পরপরই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে সংগঠনটি। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দার খুন হওয়ার পর আবারও আলোচনায় আসে সংগঠনটি। দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তারা ১৩ দফা উত্থাপন করে। ১৩ দফা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রথমে সংগঠনটি ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকা অবরোধ ও ৫ মে শাপলা চত্বরে সমাবেশের ডাক দেয়। একপর্যায়ে সমাবেশ থেকে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোরও অভিযোগে ওই রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

এতসবের পরও শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে ২০১৭ সালে ১১ এপ্রিল দেশের শীর্ষ আলেমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি সনদের স্বীকৃতি দেন। তারপর ১৩ আগস্ট ২০১৮ কওমি সনদের স্বীকৃতি মন্ত্রিপরিষদে পাস হয় এবং ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর কওমি সনদ স্বীকৃতি বিল সংসদে পাস হয়। ২০২০ সালে শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর এই সংগঠনের আমির হন মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী, মহাসচিব হন মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক।

চলতি বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে হেফাজত নানা কর্মসূচি দেয়। এক পর্যায়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ রূপ নেয় সংঘর্ষ ও তাণ্ডবে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেশ কয়েকজন `হেফাজত কর্মী‘র প্রাণ যায়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়ে সংগঠনটি। ইতোমধ্যে মামুনুল হকসহ হেফাজতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ  নেতা গ্রেপ্তারও হন।

কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নজরে নিয়েই হয়তো ওসব মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ।

কওমী মাদ্রাসার সেকাল

আমি ৮০ ও ৯০-এর দশকের একজন কওমি মাদ্রাসা পড়ুয়া। আমার সময়কার কওমি মাদ্রাসার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলে পাঠকদের আরো বুঝতে সুবিধা হবে।

সম্ভবত ১৯৭৭ সালে ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়ায় ভর্তি হই। পরে ১৯৭৯-৮০ সালে দেশের অন্যতম সেরা কওমি মাদ্রাসা জামিয়া কোরআনিয়া তথা লালবাগের এবদেয়ায়ি আউয়ালে (প্রথম শ্রেণি) ভর্তি হই। তখন লালবাগ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ (রহ.)। তিনিসহ শায়খুল হাদিস আজিজুল হক, মাওলানা আবদুল মজিদ ঢাকুভী, মাওলানা সালাহউদ্দিন প্রমুখ (রহ.) খ্যাতিমান আলেম হাদিসের দরস দিতেন।

আজকের অন্যতম শীর্ষ আলেম ও মুহাদ্দিস মাওলানা মনসুরুল হক ও মাওলানা হিফজুর রহমান, খ্যাতিমান কারি আবু রায়হান প্রমুখ আমাদের মতো নিচের ক্লাসের ছাত্রদের পড়াতেন। তখনকার লালবাগ ও হাটহাজারী মাদ্রাসাসহ সব কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষক ও ছাত্রদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি পত্রিকা, গল্প-উপন্যাস পড়াও ছিল নিষিদ্ধ। কিশোর বয়সে কওমি মাদ্রাসার এসব নিয়ম-কানুন ভালো লাগত না। যদিও আমাকে এসব কানুন খুব ছুঁতে পারেনি। কারণ, আমি আজাদ অফিস সংলগ্ন কাকার (ডা. আব্দুল ফাত্তাহ খান) বাসায় থাকতাম। বাসায় নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম।

আমি লালবাগ মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার দেড়-দুই বছরের মধ্যেই ওসব আইন-কানুন উড়ে যায়। ১৯৮১ সালে যখন মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ ওরফে হাফেজ্জী হুজুর রাজনৈতিক সংগঠন খেলাফত আন্দোলন গঠন করলেন, তখন পত্রিকা পড়া, লালবাগ মাদ্রাসায় শিক্ষক-ছাত্রদের রাজনীতি, পত্রিকা পড়া হালাল হয়ে গেল। মাদ্রাসার অধিকাংশ শিক্ষক-ছাত্র খেলাফত আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু অধ্যক্ষ মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ ও মাওলানা সালাহউদ্দিনসহ (রহ.) কয়েকজন শিক্ষক ও মুষ্টিমেয় ছাত্র কওমিদের রাজনীতিতে জড়ানোকে অপছন্দ করলেন। এ কারণে লালবাগের খ্যাতিমান এই দুই শীর্ষ আলেমকে মাদ্রাসা ছাড়তে হয়। তারা আজকের কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসানের যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় চলে যান। এই রাজনীতির কারণে লালবাগ মাদ্রাসা হারালো মাওলানা হেদায়েতুল্লাহর মতো প্রচারবিমুখ এক শীর্ষ আলেম এবং তখনকার আমলের ইলমে নাহুর ইমাম বলে পরিচিত মাওলানা সালাহউদ্দিনকে (রহ.)।

এই রাজনীতি কেবল তাদেরই লালবাগ মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত করেনি। কালের পরিক্রমায় শায়খুল হাদিস আজিজুল হক, মাওলানা মনসুরুল হক, মাওলানা হিফজুর রহমানকেও লালবাগ মাদ্রাসা ছাড়তে হয়। তখন ওই মাদ্রাসার একচ্ছত্র অধিপতি বনে গেলেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)। অবশেষে শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে মোহাম্মদপুরে জামিয়া রহমানিয়া। বর্তমানে বাবার গড়া এই মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস মাওলানা মামুনুল হক।

এই জামিয়া রহমানিয়াও ছাড়তে হয়েছে শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের সুযোগ্য শিষ্য মুফতি মনসুরুল হক ও মাওলানা হিফজুর রহমানকে। পরে তাদের নেতৃত্বেও জামিয়া রহমানিয়ার কাছাকাছি আরো একটি মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। ওই মাদ্রাসায় রাজনীতি নিষিদ্ধ। মুফতি মনসুরুল হক ও মাওলানা হিফজুর রহমানের গড়া মাদ্রাসা কওমির মূল বৈশিষ্ট্যে ফিরে গেছে অনেক আগেই।

রবিবারের সিদ্ধান্তের পর থেকে সব কওমি মাদ্রাসা ফিরে যাবে আগের জায়গায়। ৪০ বছর পর কওমি মাদ্রাসা মূল বৈশিষ্ট্যে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। বিশেষভাবে সাধুবাদ জানাই আল-হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী