কারাগারে কীভাবে সময় কাটান ওসি প্রদীপ?

প্রকাশ | ২৯ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫৬

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

এক সময় অস্ত্রের মুখে নিজেই তাড়া করতেন অপরাধীদের। নিরাপরাধ মানুষও বাদ যাননি এ থেকে। যাকে খুশি তাকে তুলে এনে নির্যাতন, আটকে রাখার মতো কাজও করেছেন হরহামেশা। অর্থের বিনিময়ে আবার ছেড়েও দিয়েছেন। টেকনাফ অঞ্চলে কথিত বন্দুকযুদ্ধে পুলিশে দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সেই প্রদীপ কুমার দাশের সময় এখন কাটছে কারাগারে।

টেকনাফ থানার সাবেক এই অফিসার ইনচার্জ প্রদীপ কুমার দাশ কারাগারে পেয়েছেন বিশেষ শ্রেণির মর্যাদা, ডিভিশন। তাই অন্য অপরাধীদের সঙ্গে একঘরে থাকতে হচ্ছে না তাকে। একাই থাকছেন। সেই ঘরেই পায়চারি করে, পত্রিকা পড়ে, শুয়ে-বসে কাটছে একসময়ের শত ব্যস্ত এই পুলিশকর্তার দিনরাত।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যা মামলায় তিনি আসামি। সেই সঙ্গে, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা দুদকের মামলাও আছে তার বিরুদ্ধে।

চট্টগ্রাম কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ডিভিশন সেলের একটি কক্ষেই থাকেন প্রদীপ। তার সঙ্গে আর কোন বন্দি নেই। সেখানে একটি খাট, ফ্যান রয়েছে। প্রতিদিন একটি দৈনিক পত্রিকা বরাদ্দ আছে। তাছাড়া বিছানা, চাদর, বালিশ ও মশারিও রয়েছে। ডিভিশনপ্রাপ্তির জন্য আছে নিজস্ব বাথরুম। আলোচিত মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় বাইরের কারও সঙ্গে যেন যোগাযোগ না হয় সে বিষয়ে সতর্ক আছে কারা কর্তৃপক্ষ।

সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কারাগারে থাকা প্রদীপকে দুদকের করা মামলায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি চট্টগ্রাম কারাগারেই আছেন। দুদকের মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন এবং ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।

কারাগার সূত্রে আরো জানা যায়, বেশিরভাগ সময় নিরিবিলি থাকেন তিনি। কারাবিধি অনুযায়ী সরকারের যে খাবার মেন্যু সেখান থেকেই খাবার খান। মাঝে মধ্যে ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে খান। কারাগারের ভিতরে আনুষ্ঠানিকতা বাদে বাকি সময়, তার মতো করেই ঘুমান। তার মতো করেই ঘুম থেকে ওঠেন। কারাগারে অন্য বন্দিদের মতো তিনি অনুশোচনাও করেন।

পরিবারের সদস্যরা কেউ দেখা সাক্ষাৎ করতে আসে কি-না এমন প্রশ্নে কারাগারের এক কর্মকর্তা জানান, পরিবারের কেউ আসেন না। আর করোনার কারণে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করা আপাতত বন্ধ রয়েছে।

মোবাইলে কথা বলার সুযোগ পায় কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না তার (প্রদীপ) কথা বলার সুযোগ নেই। নিষেধাজ্ঞার কারণে বাইরের কারও সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে পারেন না।’

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ দাশ। অভিযোগ আছে, তার পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ মদদে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খুন হন। টেকনাফে বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে অবৈধ কর্মকাণ্ডের অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছিলেন প্রদীপ কুমার। এ সম্পর্কে জেনে ফেলার কারণেই সিনহাকে খুন করা হয়।

সিনহা হত্যা মামলায় আত্মসমর্পণের পর বেশ কয়েকদফা তাকে র‌্যাবের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে গত সেপ্টেম্বরে তাকে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় সাড়ে সাতমাসে পরিবারের কেউ তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়নি। আবার নিষেধাজ্ঞা থাকায়, কারাগারে বসে স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনেও কথা বলতে পারেন না। তবে আদালতের নির্দেশে ২৬ অক্টোবর থেকে ডিভিশন সুবিধা পাচ্ছেন। আইনজীবীর মাধ্যমে বেশ কয়েকবার জামিন লাভের চেষ্টা করেও তা পাননি।

 

স্বরাষ্ট্রের তদন্ত কমিটি যা জানতে পেরেছে:

 

এদিকে সিনহা হত্যার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি জানতে পারে, প্রদীপের সময়কালে একশ ছয়টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় একশ ৭৪ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। বেশির ভাগই তার নেতৃত্বে হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে প্রদীপ বলেন, তিনি ২০-৩০ বার গুলি করেছেন, ব্যক্তিগত অস্ত্র দিয়ে। তার সাড়ে সাত লাখ টাকা দামের একটি ওয়াল্টার পিস্তল আছে। যেটা ব্যবহার তার কাছে আরামদায়ক মনে হয়।

 

যেভাবে যোগ দেন পুলিশে:

 

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর সারোয়াতলী গ্রামের হরেন্দ্র লাল দাশের ছেলে প্রদীপ। নগরীর কোতোয়ালি থানার পাথরঘাটা আরসি চার্চ রোডের বাড়িতে প্রদীপের স্ত্রী চুমকি সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতেন। ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন প্রদীপ। এসআই পদে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করতে লাগামগহীন হয়ে পড়েন প্রদীপ।

তার সম্পদ দৃশ্যমান হতে থাকে ২০০২ সালের পর থেকে। সব সম্পত্তিই প্রদীপ তার স্ত্রী চুমকির নামে করেছেন। চুমকির বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞাত আয়ের কোনো উৎস নেই। ২০১৮ সালে দুদকের তদন্ত কমিটি প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তদন্ত শুরু করে। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল তাদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে বলা হলেও চুমকি তা জমা দেন ২০১৯ সালের ১২ মে।

মামলা বিচারপ্রক্রিয়া চলছে:

 

গত বছরের ৩১ জুলাই হত্যাকাণ্ডের পর ৫ আগস্ট নয় পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার। চার মাস দশ দিন পর কক্সবাজার আদালতে ২৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেয় র‍্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যার ঘটনাটি ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। অভিযোগপত্রে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে নয়জন টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত পুলিশ সদস্য, তিনজন এপিবিএনের সদস্য এবং তিনজন বেসামরিক ব্যক্তি। এর মধ্যে পুলিশের কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক। আর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার ১৪ জন কারাগারে আছেন।

গত ৮ এপ্রিল এই মামলার দিন ধার্য ছিল জানিয়ে সিনহার বোনের আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মামলায় একজন আসামি পলাতক রয়েছেন। আর বাকি আসামিরা কারাগারে আটক। পলাতক আসামির বিচারের জন্য যেসব নিয়ম আছে, যেমন- ওয়ারেন্ট, পেপার পাবলিশড- এগুলো সব শেষ হয়েছে। দেড় সপ্তাহ আগে ফাইল ট্রান্সফার হয়ে জজকোর্টে গেছে। ওখানে স্বাভাবিক যে ট্রায়াল প্রসিডিউর আছে, সেভাবে বিচারকাজ শুরু হবে।’

মামলাটি বিচারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে ফাইলপত্র জজকোর্টে এসেছে জানিয়ে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তবে তা আদালতে উপস্থাপন হয়নি। করোনায় আদালত বন্ধের কারণে এখনো কিছু করা যায়নি। আসামিপক্ষ বেশ কয়েকবার জামিন চেয়েছে। তবে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় আসামিদের জামিন দেননি আদালত।’

(ঢাকাটাইমস/২৯এপ্রিল/এসএস/এইচএফ)