ইসলামের দৃষ্টিতে রাগ ও আত্মহত্যা: একটি মনোসামাজিক বিশ্লেষণ

ডা. শাইখ ইসমাইল আজহারি
| আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২১, ১০:৫৯ | প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল ২০২১, ১০:৫৪

রাগ মূলত হচ্ছে এক প্রকার নীরব ঘাতক। যা অহংকারের একটি অংশ। যেখানে মানুষ তার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। নিজের প্রতি কিংবা অপরের প্রতি তার আচরণের বিরুপ প্রভাব প্রকাশ পেতে পারে আবার নাও পেতে পারে। "Anger is a poison which can destroy a life silently"

রাগ এক প্রকার বিষ। যা নিরবে একটি জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। রাগ হচ্ছে এক প্রকার ক্ষুদ্রাকৃতির বিষাক্ত সাপ। যা মানুষের রক্তনালীতে বসবাস করে এবং সেখানে বিষ উৎপন্ন করে এবং সেই বিষ রক্তের মাধ্যমে সারা শরিরে ঘুরে বেড়ায় যা ঐ রাগান্বিত ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দেয় কিন্তু অন্য কাউকে করতে পারে না।

রাগান্বিত ব্যক্তি নিজের যত ক্ষতি করে পৃথিবীর অন্য কেউ তার সেই ক্ষতি করতে পারে না। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যতটা হত্যাকান্ড হয়েছে তার অধিকাংশই হয়েছে রাগের কারণে। বাকি অন্য কারণে হয়ে থাকতে পারে।

মনে করুন কেউ আপনাকে মনে ব্যথা দিলো। আপনি কষ্ট পেলেন তাহলে এতে যদি আপনার প্রতিশোধের ইচ্ছা জাগে তবে প্রথমে আপনার মাঝে রাগ আসতে হবে। যেই মানুষের কখনো রাগ হয় না সে কখনো প্রতিশোধ পরায়ণ হয় না আর প্রতিশোধ এর চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরলে কেউ কখনো শান্তিতে থাকতে পারেন না।

প্রতিশোধ চিন্তা মূলত দুই প্রকার। এর বিস্তারিত পরবর্তিতে আলোচনায় আসবে। মানুষ মূলত রাগ করে দুই জনের উপর।

১। অন্যায়ের কারণে অন্যায়কারীর উপর রাগ করে।

২। ব্যার্থতার জন্য নিজের উপর রাগ করে।

এখন এই দুই প্রকারের রাগই একজন মানুষের শান্তি নষ্ট করে দিতে পারে। একজন মানুষ যখন কারো উপর রাগ করে তখন সেই রাগ থেকে সৃষ্টি হয় অনিহা। অনিহা (Apathy) থেকে সৃষ্টি হবে ঘৃণা (Hate)। অনিহা বলা হয়, যার উপর রাগ হয়েছে তার থেকে দূরে থাকা তবে তার ক্ষতি কামনা না করা এবং তার জন্য কল্যান কামনা করা। উদাহরণস্বরূপ পরিবারের লোকের প্রতি রাগ থেকে ঘৃণা সৃষ্টি হয় না কেবল সাময়িক অনীহা আসে।

এখন রাগ থেকে যদি ঘৃণা সৃষ্টি হয় তখন তা থেকে অনেক মানসিক সমস্যা শুরু হতে পারে। তার মধ্যে উল্যেখযোগ্য হচ্ছে

১। এগ্রেসিভনেস

(Aggressiveness)

২।অবশেসন

(Obsesssion)

৩। ডিপ্রেসন (Depression)

৪। বাইপোলার ডিজঅর্ডার (Bipolar disorder)

৫। এভোয়ডেন্স পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার

(Avoidence personality disorder)

আক্রমণাত্মক মনোভাবকে এগ্রেসিভনেস বলা হয়।মানুষের রাগের মাত্রা হিসাবে তার মাঝে বিভিন্ন লেভেলের

এগ্রেসিভনেস (Aggressiveness) তৈরি হতে পারে।

এগ্রেসিভনেস দুই ধরনের হতে পারে। মানসিক ভাবে পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ মানুষ অন্যায়কারীর উপর প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে থাকে। কেউ প্রতিশোধ নিয়ে নেয় আবার কেউ নিজের ব্যার্থতার কারণে ক্ষমা করে দেয় আর বাকি ৫ শতাংশ প্রতিশোধ নেওয়ার সামর্থ থাকা সত্বেও ক্ষমা করে দেয়।

যাই হোক, অন্যায় কারীর প্রতি রাগ আসলে তা থেকে যে আক্রমনাত্মক মনোভাব তৈরি হয় এবং প্রতিশোধের যে স্পৃহা মনে আসে সেই প্রতিশোধ নেওয়া যদি কোনভাবে সম্ভব না হয়। হতে পারে তা কোনো সামাজিক কারণ। যেমন, কোনো শিক্ষক যদি ছাত্রের উপর অন্যায় করে আর ছাত্র যদি ক্ষমা করতে না পারে তাহলে তার মধ্যে সেল্ফ এগ্রেসিভনেস (Slef aggressiveness) তৈরি হতে পারে, যেটা যেকোনো মুহুর্তে নিজেকে আক্রমণ করতে পারে কিংবা ডিপ্রেশন বা অবশেসন হতে পারে আবার নিজের ব্যর্থতায় যদি অন্যায়কারী থেকে প্রতিশোধ নেওয়া

না হয় তাহলে রাগের কারণে যে আক্রমণাত্মক মনোভাব তৈরি হয়েছে সেই আক্রমণাত্মক মনোভাব নিজের দিকে ফিরে আসে অর্থাৎ নিজেকে আক্রমণ করার মনোভাবে জেগে উঠে এবং এটা তীব্র থেকে তীব্র হলে মানুষ আত্মহত্যা করে ফেলে।

এখন আত্মহত্যার মাঝে রাগের দুইটা দিক সমানভাবে অংশগ্রহণ করে।

১..অন্যায়কারী উপর রাগ

২..নিজের ব্যার্থতার কারণে নিজের উপর রাগ

যখন দুই দিকের রাগ এক হয়ে যায় আর এই রাগ যদি দীর্ঘক্ষণ মনের মাঝে থাকে তাহলে রাগ থেকে সৃষ্টি হবে ঘৃণা, ঘৃণা থেকে এগ্রেসিভনেস, এগ্রেসিভনেস থেকে ডিপ্রেসন তারপর অবসেশন।

প্রথমেই বলেছি রাগ একটি বিষাক্ত সাপ। রাগ করার সাথে সাথেই এই সাপ মানুষকে তার রক্তনালীর ভিতরে কামড়াতে থাকে যার উপসর্গ প্রকাশ পায় ঘৃণা আর বিষন্নতার মাধ্যমে আর এই উপসর্গ এতই যন্ত্রনাদায়ক হয়ে যায় যে মানুষ এই রাগের কাছে পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করে। আর যারা ধৈর্যশীল তারা এই রাগ নামক সাপের কামড়ের মাঝেও আল্লাহর উপর ভরসা করে পথ চলে। রাগ তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

পৃথিবীতে যতটি আত্মহত্যা ঘটেছে তার অধিকাংশই রাগের কারণে হয়েছে। এই রাগ হয়তো অন্য কারো উপর ছিল কিংবা নিজ ব্যার্থতার কারনে নিজের উপররাগ ছিল আর তা থেকে আত্মহত্যা। রাগ হচ্ছে ধৈর্যের বিপরীত। মুসলমানের সবচেয়ে শ্রেষ্ট চরিত্র হচ্ছে ধৈর্য ও ক্ষমা। একজন প্রকৃত আল্লাহর অনুগত বান্দার মাঝে রাগ ও ধৈর্য একত্রিত হতে পারে না।

রাগ ব্যতিত কোনো আত্মহত্যা সম্ভব না। প্রতিটি মানসিক রোগের পিছনে মূল কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে রাগ। শেষ করছি, রাসূল কারীম (সাঃ) এর একটি হাদীস দিয়ে। হযরত আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, "আমি রাসূল কারীম সাঃ এর আরয করে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে একটি আমল বলে দিন, যা দিয়ে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব, তখন রাসূল কারীম সাঃ বলেন, তুমি রাগ করো না, কোনো কোনো রেওয়ায়েত এসেছে, রাসুল কারীম তিন বার প্রশ্ন করা হলে তিন বারই একই উপদেশ দেন"। ( সূত্র:তাবরানী)

হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল কারীম (সাঃ) এর কাছে এসে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে অল্প কিছু উপদেশ দিন, যা দ্বারা আমি শান্তিতে বসবাস করতে পারব, বেশি উপদেশ আমার মনে থাকে না, তাই আমাকে অল্প কিছু উপদেশ দিন, তখন রাসুল কারীম (সাঃ) বলেন, রাগ করো না। তুমি তোমাকে এই শয়তানের চরিত্র থেকে রক্ষা কর, রাগ করো না (মুসনাদে আহমদ) বাইহাকী শরীফ (১৪/২২৬) (বোখারী শরীফেও এসেছে এই হাদীস)

তাই আমাদের এই রাগ নামক বিষাক্ত সাপকে হত্যা করতে হবে।যে কোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে। সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয় ভালো কিংবা খারাপ সব আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। তাই অপরের প্রতি কিংবা নিজের প্রতি কখনো রাগ করবেন না।

ব্যর্থতার মাঝেই রয়েছে ধৈর্য নামক পরীক্ষায় অনন্য সফলতা। ইমানের দাবি হচ্ছে ভালো খারাপ, বিপদ আপদ সব আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে আর ধৈর্যের মাধ্যমে আমাদের ইমানের প্রমাণ দিতে হবে আল্লাহর কাছে। আমাদের মানসিকতা এভাবে গড়ে তুলতে পারলেই আমাদের সমাজকে এবং আমাদের প্রজন্মকে আমরা আত্নহত্যা নামক আরেক মহামারি থেকে রক্ষা করতে পারব।

লেখক: এমবিবিএস, এমপিএইচ, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, সেন্টার ফর সাইকোট্রমাটোলজি এন্ড রিসার্চ

ঢাকাটাইমস/২৯এপ্রিল/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা