প্রাণশক্তি না জ্ঞানশক্তি!

প্রকাশ | ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১১:৫১

জি এম কিবরিয়া

তিন বছরের একটি শিশু কত উচ্ছ্বসিত! সৃষ্টির আনন্দে, অজানাকে জানার আকাঙ্খায় এবং বিশ্ব জয়ের উল্লাসে সারাক্ষণ মত্ত থাকে সে। এতটুকুও যেন ক্লান্তি নেই; সারাদিন দৌড়াদৌড়ি, হৈ-হুল্লোর, হাসি-আনন্দ, জেদ-অভিমান-বায়না; আরও কত কি!

শিশুর এই উচ্ছ্বসের নামই প্রাণ শক্তি।

এই প্রাণের উচ্ছ্বাস কার না ভাললাগে? যদি বিপত্তি না ঘটতো! দেখবেন, সে ক্রমাগত বিপদের পর বিপদে পরছে। এখানে ধাক্কা, নয় ওখানে টক্কর! হয়তো মাথা ফুলিয়ে, নয়তো ফাটিয়ে ফেলছে! ভেঙ্গে ফেলছে হাত-পা। আর একি হাল ঘরের জিনিস পত্রের? এটা ভাঙ্গছে নয় ওটা! একেবারে যেন বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।

এ অবস্থার জন্য কি ঐ প্রাণ শক্তিরই দায়ী? আপাতত মনে হলেও আসলে না। মূলত শিশুর এই প্রাণশক্তি ইমব্যালেন্স হয়ে যাচ্ছে পরিপক্কতার অভাবে। অর্থাৎ শিশুর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণে ঐ প্রাণশক্তির প্রয়োগ পরিপক্ক ভাবে  ঘটেনি। এই পরিপক্কতা অর্জন করতে ছয় থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত লেগে যায়। এর পরও মানুষ পরিপক্ক হয়, তবে তখন দৃষ্টি জ্ঞানের বিস্তৃতিই ঘটে বেশি।

মজার ব্যাপার হলো, মানুষ যতই জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, কর্ম-অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক হতে থাকে ততই সে এই মহামূল্যবান প্রাণশক্তি বা জীবনীশক্তিটুকুই হারিয়ে ফেলতে থাকে! এই প্রক্রিয়াটি জীবনের বিপত্তি, চরম বিপত্তি! তখন প্রাণশক্তির অভাবে পরিপক্ক বা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষগুলো কেমন যেন আধমরা হয়ে যায়। কোন রকমে বেঁচে থাকার জন্যই যেন তারা বেঁচে থাকে! সবকিছুতে কেমন একটি বিরক্তি ভাব। জীবনটাই যেন তিতো তিতো লাগে! এমনকি রসগোল্লাও তার কাছে তিতো ঠেকে! নাহ! আমার তো ডায়াবেটিস! যে ভালবাসার মানুষটিকে এক নজর দেখতে খাল সাঁতরে উপারে যেতেন, তার সাথে এক খাটে থাকাটাও যেন এখন বিরক্তিকর! তিনি ঘুম থেকে উঠেনই রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে, ঠিকমত বাথরুম হয় না, বুক ব্যাথা, পিঠ ব্যাথা, ছেলে কথা শুনে না তো মেয়ে মোবাইল নিয়ে সারাদিন। সব কিছুতেই না আর না। ফলে বিরক্তি আরও বাড়ে! গিন্নির ভাল কথাটাও গা জ্বলে! কোন রকমে অফিসে গিয়ে জুনিয়র কলিগকে বলেন, "আমরা আর ক'দিন! এখনতো আপনারা কাজ করবেন!" কেন স্যার? "এই সামনে পিআরএল।" স্যার কবে? এই ধরেন ২০৩৭ সালে! এ কথা শুনে জুনিয়র কলিগের বড় নিশ্বাস ছাড়া ব্যতিরেকে আর কিছুই করার থাকে না! "ভাতারও মরলো, রঙ বেরঙের চুড়িও বের হলো।" অর্থাৎ প্রাণশক্তি প্রয়োগের জন্য যথেষ্ট বোধশক্তি এলো কিন্তু সেই প্রাণশক্তিই হারিয়ে গেল! কি আর করা?

দেখুন না, গল্পটা কত মজার! শিশুকালে জ্ঞানহীন প্রাণশক্তি বিপত্তির কারন ছিল, এখন প্রাণশক্তিহীন জ্ঞান যেন জীবনকে বয়ে বেড়াতে পারছে না! একটি গল্প মনে পরে গেল। এক বাবনার (বামুন ঠাকুর) গল্প। "তো প্রচন্ড শীতে বাবনার জীবন আর বাঁচে না, তবুও দাঁতে দাঁত চেপে পৌষ মাসটি কাটিয়ে দিল, খুব কষ্টে! মাঘ মাসও শেষ হয় হয় অবস্থা। এদিগে শীতের কামড়ে বাবনা যেন মরেই যাচ্ছেন! তাই তিনি ক্রেজি হয়ে উঠলেন। আর মানবো না শীতের বাহাদুরি। যেই কথা সেই কাজ। সংসারের একমাত্র দুধাল গাভী বিক্রি করে তিনি লেপ-কাথা কিনে ফেললেন। বিপত্তিটি ছিল সেখানে, যেদিন লেপ-কাথা কিনলেন, সেদিন

থেকেই ফাল্গুনী হাওয়া বইতে শুরু করলো। এখন লেপ-কথা দিয়ে কি করবেন। গাভী ছাড়া যে ভাতই চলে না।" এখানে প্রাণ ছাড়া জ্ঞানও একই শংকটে পতিত!

এই মহাসংকটের সমাধান কি?

যেহেতু, প্রাণশক্তি জ্ঞানশক্তি একে অপরের পরিপূরক, সেহেতু দুটোর সমন্বয়ের মধ্যেই সমাধান লুকাইত। এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রাণশক্তিকে ধরে রাখা যায়?

খুব সহজে আপনি জ্ঞানশক্তি ও প্রাণশক্তির সমন্বয়ে জীবনকে আনন্দঘন, অর্থবহ ও কল্যাণকর করে তুলতে পারবেন। এর জন্য কোন কাঠখড়ই পোড়াতে হবে না। শুধু আপনার ইচ্ছা শক্তিই যথেষ্ট। জাষ্ট ২০-৩০ মিনিটের একটি নিয়ম পালন করুন প্রতিদিন। ব্যাস, তাতেই হবে। যেমনঃ

১। মহাজগতের তুলনায় আপনার অস্তিত্বকে নিয়ে ভাবুন, যেখানে পৃথিবী একটি বালু কনার চেয়ে ছোট, সেখানে আপনি মশাই কি? এতে আপনার অহংকার, অবিশ্বাস ও অস্থিরতা কমবে, বিপরীতে ধৈর্য্যতা ও স্থিরতা বাড়বে।

২। এই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণি মানুষ। লক্ষ কোটি বছরের বিবর্তণে ফলে এই উন্নত যন্ত্রটি আমরা পেয়েছি, যেখানে আমাদের পূর্ব পুরুষগণ গুহায় বসবাস করতো, এখন আমাদের হাতের মুঠোয় বিশ্ব। এই সভ্যতা প্রতিটি প্রজন্মেরই অবদান আছে। পূর্ব পুরুষদের আগুন, চাকার উপর ভর করেই কিন্তু আজকের এই সভ্যতা। তো, কালের সভ্যতায় আপনারও বিরাট অবদান রাখার সুযোগ আছে। তাই পজিটিভ ভাবুন। এই ভাবনা আপনার কর্মস্পৃহা বাড়বে।

৩। নদীর স্রোতের মতো সময় বয়ে যাচ্ছে। আসলে কি তাই? না, সময় নয়, আমাদের জীবন বয়ে যাচ্ছে। একঘন্টা কিংবা একদিন চলে যাওয়া মানে আপনার মূল্যবান জীবনের একটি মূল্যবান অংশ নিঃশ্বেস হয়ে যাওয়া। তাই প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগান, এই কথা বলব না, কারন এটি অসম্ভব। আমি বলতে পারি, প্রতিটি মুহূর্তেই খুশি থাকুন, আনন্দে থাকুন। কারন এটি সম্ভব। আপনি পৃথিবীতে কিছুই নিয়ে আসেননি বা সাথে করে কিছুই নিয়ে যাবেন না। তাই নাই নাই করে কিংবা পরশ্রী কাতর হয়ে জীবন কাটিয়ে দিবেন না। লম্বা দম নিন, বাঁচুন প্রাণ ভরে যেন প্রতিটি দিনই নতুন, প্রতিটি দিনই আপনার জন্য শুভ।

৪। শরির মহাশয়কে ফিট রাখুন। ভাবছেন খুব কঠিন? অথবা ভ্রু কুঁচকে বলছেন, জিমে যেতে হবে? না, মোটেই না। শুধু ১০/১৫ মিনিটে মাত্র ১০টি অভ্যাস করুন নিয়মিত, ব্যাস আপনি থাকবেন চাঙ্গা ও ফিট, একেবারে ফুরফুরে।

অভ্যাস গুলো কি কি?

১। আপনি বেঁচে আছেন, এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে! পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠে না। তারা ঘুমেই মারা যায়। আপনি তাদের একজনও হতে পারতেন! ঘুম থেকে উঠে যখন দেখবেন আপনি বেঁচে আছেন তখন সেই আনন্দে একটি বড় করে হাসি দিন। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিন। তিনি আপনাকে আরেকটি সুন্দর দিন উপহার দিয়েছেন। আরেকটি হাসি ও স্রষ্টাকে আরেকবার ধন্যবাদ দিন, যখন দেখবেন আপনার পরিবার স্বজন সবাই ভাল আছে।

 

২। কাত হয়ে শোয়া থেকে উঠুন।

৩। যোগ আসনের মতো বসুন। নাক দিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস নিন, একটু ধরে রাখুন এরপর ধীরে ধীরে শ্বাস ছেড়ে দিন। শ্বাস নিতে নিতে ভাবুন প্রকৃতির অফুরন্ত প্রাণশক্তি আপনার ভিতরে প্রবেশ করছে আর স্বাস ছাড়তে ছাড়তে ভাবুন দেহের সব দূষিত পদার্থ বের হয়ে যাচ্ছে। এভাবে বেশ কয়েকবার করুন। এতে শরিরে প্রচুর অক্সিজেন সরবরাহ হবে। অনেক হালকা মনে হবে। এটি করোনায়ও আপনার ফুসফুসকে নিরাপদ রাখবে।

৪। খালি পেটে এক গ্লাস পানি পান করুন।

৫। এবার টেবিলে বসে নোটবুকে কলম দিয়ে (মোবাইলে নয়) লিখে ফেলুন, আজকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ কি কি। দুই মিনিট চোখ বন্ধ করে ভাবুন কিভাবে কাজ গুলো করবেন। পরবর্তীতে প্রতিদিন রাতে আবার মিলিয়ে নিন, কি করেছেন আর কোনটা বাদ পরল, কেন করতে পারেননি, তা লিখুন একদম সংক্ষেপে।

৬। স্বাভাবিক নিয়মে বাথরুম করুন। বাথরুম যদি না হয়, চাপাচাপি করবেন না। প্রতিদিন শোয়ার পর শরীরকে নির্দেশ দিন, ঘুম থেকে উঠে পানি খাওয়ার কিছুক্ষণ পর বাথরুম হবে। এই কথাটি মন থেকে বলুন। এই আদেশ দেহ মনে রাখবে।

৭। চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে হাতমুখ ধোয়ে নিন।

৮। এবার পাঁচ-দশ মিনিট হালকা ব্যায়াম করুন। পাখির মতো হাত-পা ছড়িয়ে ও বন্ধ করে ব্যায়াম করতে পারেন। তারপর শরির গরম হলে শরিরকে স্থির রেখে আস্তে আস্তে ঘার মুভমেন্ট করুন। কোন তাড়াহুড়ো করবেন না। ঘার অনেক সেনসেটিভ ও প্রয়োজনীয়। সমস্ত সিগনাল শরীরে পৌছায় এই ঘারের মাধ্যমে। তাই একে নমনীয় রাখুতে নিয়মিত ঘারের ব্যায়াম  করুন।

৯। এবার স্বাভাবিক পানিতে গোসল করে নিন। কুসুম গরম পানি শরীরের জন্য উপকারী। শরিরে পানি ঢালতে ঢালতে ভাবুন জলের ধারায় সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ক্লান্তি ও বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যাচ্ছে, আর আপনি একটি তরতাজা, সদ্যজাত ও আশাবাদী একজন মানুষ হয়ে উঠছেন। মনে রাখবেন, এই পৃথিবী, প্রকৃতি ও মানুষের জন্য আপনার বেঁচে থাকাটা জরুরি। আপনাকে বাঁচতে হবে তাদের জন্য। সকলের আনন্দের জন্য।

১০। এবার ভারী ও ভাল মানের একটি নাস্তা করে নিন।

মাত্র দশটি অভ্যাস, ব্যাস তাতেই হবে। এভাবে চিন্তার পরিবর্তন ও অভ্যাসের মাধ্যমে আপনি ফিরে পাবেন প্রাণশক্তি। আর প্রাণশক্তি ও জ্ঞানশক্তির সমারোহে আপনি হয়ে উঠবেন অনন্য একজন মানুষ। আপনার আনন্দময় একটি জীবন বদলে দিতে পারে গোটা পৃথিবীকে। আর এভাবেই পৃথিবী হয়ে উঠবে হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত এক সুন্দর ও নির্মল আবাস। এখানে বয়স কোন ফেক্টর নয়। আপনি ৭০-৮০ যাই হোন না কেন, মেনে চলুন ও সতেজ নির্মল থাকুন, আমৃত্যু। মনে রাখবেন, নিরানন্দ কোন মানুষ যেমন কখনো অপরকে আনন্দ দিতে পারে না ঠিক তেমনি একজন অসুখি মানুষও কখনো কাউকে সুখি করতে পারে না।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ পৃথিবীতে এখন চলছে করোনা মহামারি। মৃত্যু আমাদের ঘ্রাস করে ফেলতে চাইছে। এই করোনায় আপনাকে নিরাপদ রাখতে প্রাণশক্তির বিকল্প নেই। আপনি যখন উচ্ছ্বসিত, সুখি ও ঝরঝরে জীবনের অধিকারী হবেন, করোনা তেমন কিছুই করতে পারবে না। তবে সর্বদাই স্বাস্থ্য বিধি মেনে চশুন। মাস্ক ব্যবহার করুন।

জি এম কিবরিয়া

প্রতিষ্ঠাতা,ক্লিন এন্ড গ্রিন ফাউন্ডেশন ও গরিব ফাউন্ডেশন।