‘সন্তানদের এমন আপ্লুত স্পর্শ আমায় স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়’

তানভীর শাহরিয়ার রিমন
| আপডেট : ০১ মে ২০২১, ০৯:০৬ | প্রকাশিত : ০১ মে ২০২১, ০৮:৫৭

কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ শুরুর পর থেকেই বিষয়টা আমি লক্ষ্য করেছি তবে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, লেখক, ও খ্যাতনামা কলামিস্ট তারেক শামসুর রাহমানের লাশ নিজের বাসা থেকে দরজা ভেঙে উদ্ধার করা হয়েছে’ এই খবরটা চাউর হওয়ার পর থেকে আব্বাকে আরো বেশি বিচলিত মনে হচ্ছে । এমনিতেই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আব্বা তার এক বন্ধুকে ফোন করেন। এখন বরং অনেকটা রুটিন কাজের মতো করেই তিনি এটা করছেন ।

আমি আব্বাকে ইফতারের টেবিলে বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

-আব্বা প্রতিদিন দেখছি সকালে ঘুম থেকে উঠেই আপনি আংকেলকে ফোন দিচ্ছেন? ঘটনা কী?

-ঘটনা কিছু না রে বাবা, তোমার আংকেল তো একা থাকে। এতো বড় বাড়ি, কিন্তু একটা মাত্র প্রাণ। বয়স হয়েছে তো প্রায় আমার কাছাকাছি (৭০)! অথচ এই বয়সে সন্তানদের থেকে কতদূরে আছে! মরেটরে পড়ে থাকলে তো কেউ টেরও পাবে না এই মহামারির সময়! তাই প্রতিদিন সকালে ফোন করে দেখি যে ঠিকঠাক আছে কিনা!

আব্বার বন্ধু সিলেটে থাকেন। সিলেট উপশহরে দুতলা বাড়ি তার। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। বিপত্নীক। আন্টি মারা গেছেন ৫/৬ বছর হয় । আংকেলকে অনেকে বিয়ের পরামর্শ দিলেও তিনি আর বিয়ে করেননি। তার দুই ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করে বিদেশেই স্যাটেল করেছে। একজন কানাডায় অন্যজন অস্ট্রেলিয়ায়। আর মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন এক প্রবাসী ডাক্তার এর কাছে, ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন তারা। আংকেল বছরে তিনবার ছেলে মেয়েদের কাছে ঘুরতে যান। একেকবার গেলে মাস খানেক থাকেন।

আব্বাকে বলি, আংকেল একবারে ছেলেদের কাছে চলে গেলেই তো পারেন!

-না, সে যাবে না। আমরা তো কত বলি। কিন্তু সে দেশে থাকবে। তার ধারনা সে বিদেশে চলে গেলে তার সম্পত্তিগুলো লোকজন ভোগ দখল করবে।

-আংকেল তো বাসায় তার কোনো আত্মীয়-স্বজনকে এনে রাখতে পারেন !

-এটাও সে করবে না! আমি বলেছি অন্তত একটা ছেলে রাখ, তোর দেখাশোনা করবে, বাজার করে দেবে। ওষুধ এনে দেবে। কিন্তু না, সে সব নিজে নিজে করতে চায়!

আব্বা বলেন, লকডাউন শেষ হলে চিন্তা করছে ঢাকা বসুন্ধরায় তিনটা ফ্ল্যাট কিনে ছেলে-মেয়েদের গিফট করবে। তা তোমাদের কোনো প্রজেক্ট আছে বসুন্ধরায়?

-আছে আব্বা। তবে আপনার কী মনে হয় উনার ছেলে মেয়েরা ওই ফ্ল্যাটগুলোতে এসে কখনো থাকবে?

-তা মনে হয় থাকবে না ।

-তাইলে আব্বা আংকেলকে বলেন, ফ্ল্যাট কিনার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিতে।

-আসলে ওর কাছে অলস টাকা পড়ে আছে সেজন্য আমাকে বলছে তোমার সাথে কথা বলতে।

-আব্বা, আংকেলের একাউন্টে কত টাকা আছে এটা হয়ত আংকেল জানেন, কিন্তু উনার একাউন্টে কত সময় আছে সেটা কি উনি জানেন?

আব্বা চুপ হয়ে যান।

আব্বা, উনি যদি ছেলে-মেয়েদের কিছু গিফট করতে চান তবে উনাকে সময় গিফট করতে বলেন। দুনিয়াতে এর চেয়ে মূল্যবান উপহার আর কিছু নাই। উনাকে বলেন নি:সঙ্গ জীবন ছেড়ে ছেলে-মেয়েদের কাছে চলে যেতে।

কথা প্রসঙ্গে আব্বা বলে উঠেন, দু’তিনদিন আগে লিটুর সাথে (আমার লন্ডন প্রবাসী ছোট ভাই তানজীবের পেট নেইম) কথা হচ্ছিল। তার সাথেও তোমার আংকেল এর বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তো আমি হঠাৎ করে বললাম, রিমন দেশে আছে বলে বেঁচে গেছি! নয়তো সিলেটে আমাকেও এরকম নি:সঙ্গ দিন কাটাতে হতো !

লিটু বলল, না আব্বা, আপনাকে কী আমরা একলা একলা থাকতে দিতাম নাকি? ভাইয়াও যদি বিদেশে থাকতেন; আপনি ছয়মাস ভাইয়ার সাথে, ছয় মাস আমার সাথে থাকতেন!

আব্বা লিটুর কথা শুনে নাকি হেসেছিলেন!

আমি একটু নস্টালজিক হয়ে পড়ি। হ্যাঁ, আমার বাইরে স্যাটেল করার একটা প্ল্যান ছিল বটে। সেটা প্রায় ১৯ বছর আগের কথা। আমার ক্যারিয়ারের চিন্তা করে আম্মা খুব করে চাইতেন। আমি বরং নানা যু্ক্তি দিয়ে আম্মাকে বুঝিয়ে দেশে থেকে গেছি। আম্মা একসময় আমার সেই সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিল তা বলেছেন। বিশেষ করে আম্মা যখন ক্যান্সার নিয়ে লড়ে যাচ্ছিলেন, আমাকে প্রায়ই কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলাতেন। বলতেন, তুই যদি আমার কথা শুনে চলে যেতি, কী হতো আমার!

আম্মা তখন ব্যাংকক হসপিটালে। মাসে ২/৩ বারও যেতে হতো আমাকে। তারপর যখন দেশে আসলেন তখন নিয়মিত ইউনাইটেডে নিয়ে যাওয়া। আম্মা বারবার বলতেন, তুই না থাকলে কে করত এসব? আমি আম্মাকে বলতাম, আম্মা, আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরিকল্পনাকারী। তিনি যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন।

আম্মা মাথা নাড়তেন।

আম্মা যখন চলে গেলেন তার ১ বছর আগে থেকেই আমার ছোট ভাইয়ের বৃটিশ নাগরিকত্ব ইস্যুতে পাসপোর্ট ওরা হোল্ড করে রাখে। আম্মা খুব দেখতে চাইতেন লিটুকে। ছটফট করতেন। ভিডিও কলে প্রতিদিন কথা বলতেন। এভাবে একদিন আম্মা চলে গেলেন। লিটুকে শেষ দেখা দেখতে পারলেন না। আমি আম্মার কষ্টটা টের পেতাম।

আম্মা যেদিন রাতে মারা যান সেদিন সকালে আমি ঢাকা থেকে সিলেটে যাই আম্মাকে ইউনাইটেড থেকে সিলেটের ভালো কোনো হসপিটালে শিফট করার জন্য। ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন আম্মার হাতে খুব একটা সময় নেই। আর আম্মাও সিলেট যেতে চাচ্ছিলেন। আমি সিলেট পৌঁছে ফেরার কোনো ফ্লাইটে টিকিট পাচ্ছিলাম না। আব্বাকে জানাই, আব্বা বলেন না পেলে কাল সকালের ফ্লাইটে আসো । বাসে আসতে যেওনা। অথচ বিকালেই আমার ট্রাভেল এজেন্ট ফোন করে বলে যে রাত ৮টার ফ্লাইটে একটা টিকিট পাওয়া গেছে! আমি রাত দশটায় হসপিটালে পৌঁছি। আম্মা আমার হাতের ওপর কালেমা পড়তে পড়তে রাত ১টার দিকে চলে যান ।

সকালেই আম্মাকে নিয়ে সিলেটে ফিরি। আমি নিজে কবরে নামিয়েছি আম্মাকে, নিজ হাতে অনন্ত ঘুমের বিছানায় শুইয়েছি।

আম্মা মারা যাবার তিন মাসের মাথায় বৃটিশ পাসপোর্ট পেয়ে যায় আমার ভাই! তবে কী এইসব মহান আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ? দুনিয়ায় তিনি মনে হয় মানুষের সব চাওয়া পূরণ করেন না। পরকালের জন্য অনেক কিছুই হয়ত রেখে দেন। এবং আমরা সেই আশাগুলো নিয়ে বেঁচে থাকি যে এই দুনিয়ায় না হোক অন্য দুনিয়ায় ঠিকই পূরণ হবে আশা!

আমি এমনিতেই খুব আবেগপ্রবণ মানুষ। জীবনে মাথা দিয়ে নয় বরং হৃদয় দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সবসময়। আব্বার সাথে কথা বলতে বলতে কেন জানি মন খারাপ হয়ে উঠে আমার। আংকেল এর জায়গায় নিজেকে ভাবতে থাকি। আমাদেরও তো বয়স বাড়ছে। বেঁচে থাকলে একসময় ওইরকম বয়সে হয়ত যাব। আমার সন্তানরা তখন কোথায় থাকবে? ওরাতো বিদেশে পড়াশোনার পরিকল্পনা করছে!

জীবনে অর্থবিত্তই সব নয়। প্রিয়জনের একটুখানি ছোঁয়া, একটু যত্ন, খুনসুটি এই সবই জীবনের পরমানন্দ! কী লাভ বলেন তো, যদি নিজের সন্তান কিংবা প্রিয়জনরা পাশে না থাকে, যদি এক কাপ চা কিংবা ওষুধের শিশিটা এগিয়ে দেয়ার জন্য গৃহপরিচালিকার ওপর নির্ভর করতে হয়। যদি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করার সময় নিরন্তর আফসোস নিয়ে কবরে যেত হয়?

আমার আর আব্বার কথাবার্তা পাশে বসে শুনছিল আমার ছেলে তেহজীব। সে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা, ডোন্ট বি আপসেট! পড়াশোনা শেষ করে আমি ঠিকই তোমাদের কাছে চলে আসব! আমার মেয়েটাও ভাইয়ের দেখাদেখি আমাকে একই রকম করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।

সন্তানদের এই আপ্লুত স্পর্শ স্বর্গীয় অনুভূতি দেয় আমায়...!

লেখক: সিইও, র‌্যাংকস এফসি প্রোপারটিজ লিমিটেড

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :