শ্মশানের চিমনি গলেছে, কমেনি পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা

মো. আক্তারুজ্জামান
 | প্রকাশিত : ০১ মে ২০২১, ১২:০৮

করোনাভাইরাসের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের কাছে সমস্ত পৃথিবী আজ অসহায়। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটিতে শনাক্ত এবং মৃত্যুর পরিমান এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি। সম্ভবত পৃথিবীতে এমন কোন জনবসতি নেই যেখানে করোনাভাইরাসের নিষ্ঠুরতার ছাপ পড়েনি। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ আজ স্রষ্টার অদৃশ্য এক সৃষ্টির কাছে চরম অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করে চলেছে। প্রতিদিন এই নরঘাতক জীবাণুটি তারই ধ্বংসযজ্ঞের গতিকে ছাড়িয়ে চলেছে।

চলতি সপ্তাহের ২৩ এপ্রিল worldometers.info এর হিসাব অনুসারে এই দিনটিও বিশ্বব্যপী করোনার ধ্বংসাত্মক রেকর্ড বইটি পূর্ববর্তী দিনের সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে। আর এই রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ার ঘটনা ঘটেই চলছে প্রতিনিয়ত।

কেউ জানেনা এই অদৃশ্য দানবের ভীতিমুক্ত পৃথিবী আবার কবে আমাদের মাঝে ফিরবে নাকি এই আমাদের মাঝে আদৌ ফিরবে না!

একথা নিশ্চিত করে বলা যায় পৃথিবী নিশ্চয়ই একদিন আবার করোনার করাল গ্রাস হতে মুক্ত হবে, আমরা তার সাক্ষী বা ইতিহাস যা-ই হই না কেন। তবে যে ইতিহাসের সাক্ষী আমরা ইতিমধ্যে হয়ে গেছি তা মোটেও সুখকর নয়। একথা সত্য আমরা একদিকে ক্ষুদ্র উদ্যোগে মানুষের ভেতর দেখেছি অতিমানবদের, যাদের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করলে মাটির পৃথিবীকে জান্নাত মনে হয়।

এ তালিকায় আমরা ভারতে দেখেছি রতন টাটার মতো দেবদূতকে, বাংলাদেশে দেখেছি স্বপরিবারে নারায়নগঞ্জের খোরশেদ কমিশনার মহোদয়কে, আমরা দেখেছি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, মৃতদেহকে সৎকার করতে যখন নিজের সন্তানেরা পালিয়ে গেছে, আমরা দেখেছি তাকওয়া ফাউন্ডেশনকে।

এমন নাম না জানা অনেক মহামানব ও মহামানবীয় প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা যায়। সমস্যা হচ্ছে ভালো মানুষগুলো অধিকাংশ সময়ে হয় ক্ষমতাহীন আর এর বিপরীতে ক্ষমতাধর প্রাণীগুলোর বেশীরভাগ হয় পিশাচ।

বিশ্বের এই ভয়াবহ অবস্থার ভেতর আমরা হতভম্বের মতো প্রত্যক্ষ করি সেসব বিকারগ্রস্থ অমানুষদের ভয়াবহ অর্থক্ষুধাকেও। পুঁজিবাদী স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য সম্ভবত পৃথিবীর বুকে এই হায়েনারা কিয়ামতকে আমন্ত্রণ করতে দ্বিধা করবে না।

একদিকে সমস্ত পৃথিবী যখন মৃত্যুর আতঙ্কে প্রকম্পিত অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মোড়লেরা স্বার্থ আর প্রভাব বিস্তারের মোহে মোহাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে।

মানুষের দূর্বলতাকে পুঁজি করে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ তাদের অনুসারিরা নতুন নতুন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। এই রাজনীতি মানুষকে বাঁচানোর নাম দিয়ে স্বার্থের জাল বিস্তারের অশুভ প্রতিযোগিতা, এই রাজনীতি অন্যকে দমিয়ে সারা বিশ্বে নিজের প্রাধান্য বিস্তারের ভয়ঙ্কর আকাঙ্ক্ষা। করোনার বিভীষিকাময় তান্ডবে আজ দিশেহারা অবস্থায় দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে প্রতিবেশি দেশ ভারতের জনগণকে।

মহারাষ্ট্র থেকে দিল্লি, উত্তর প্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সমস্ত জনপদে চলছে মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল। আক্রান্ত এবং মৃতের রেকর্ড বিবেচনায় প্রতিদিন দেশটি অতিক্রম করছে নিজরে পূর্ববর্তী অবস্থাকে। আক্রান্তের পরিমান এখন প্রতিদিন সাড়ে তিন লক্ষ অতিক্রম করেছে আর মৃতের সংখ্যা দাপ্তরিকভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে দিনে তিন হাজারের উপরে যা প্রকৃত সংখ্যার অনেক বেশি। এ সম্পর্কে গত ২৫ এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ‘...with mounting evidence that the actual death toll is far higher than officially reported’

যদিও মৃত্যুকে সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না। যে পরিবারটি তার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারায় সেই পরিবারের স্ত্রী, সন্তান, নির্ভরশীল বৃদ্ধ বাবা-মা কেবল বুঝতে পারেন তারা কী হারিয়েছেন। তথ্য গোপন করতে চাওয়া আদিত্যনাথ যোগী (২৫ এপ্রিল প্রকাশিত এনডিটিভির সূত্র অনুযায়ি সরকারের সংকট নিয়ে সমালোচনা করলে যিনি ‘পরিবেশ নষ্টের চেষ্টার’ অভিযোগে সুরক্ষা আইনে পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়েছেন) বা কোন চরম দুর্নীতিগ্রস্থ একনায়ক সরকারের পক্ষে স্বজন হারানোর এই বেদনা উপলব্দি করা সম্ভব নয়। তাদের কাছে মৃতের সংখ্যা অযুত, লক্ষ, নিযুত বা কোটি যা-ই হোক না কেন এগুলো নিছকই সংখ্যা।

সমগ্র ভারত জুড়ে যখন চলছে শোকের মাতম, চিতা পোড়ানোর লেলিহান শিখা যখন ভারতের আকাশকে বিবর্ণ করছে তখনও আমরা প্রত্যক্ষ করি দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের পুঁজির মৃত্যুক্ষুধা, বুঝি মৃত্যুও তাদের এই ক্ষুধা মেটাতে পারবে না! ঠিক যে সময়টাতে আইপিএল-এর একটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে সে সময়ের মধ্যে ভারতের শ্মশান বা কবরস্থানে শেষকৃত্যের দীর্ঘ লাইনের টিকিট হাতে যুক্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মৃতের স্বজনেরা। খেলাকে যেদিন বিনোদনের খোলস থেকে বের করে পুঁজির খোলসে আবদ্ধ করা হয়েছে সেদিন থেকে মানুষের হাসি-আনন্দ, জীবন-মৃত্যুর সাথে খেলার কোন সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক শুধু পুজিঁর আর পুজিঁপতিদের।

ভারত সহ বিভিন্ন দেশের রাজনীতিও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যায় ক্ষমতা, প্রভাব, রাজনৈতিক শক্তি আর অর্থের বিপরীতে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদগণ জনগণকে, জনগণের জীবনকে নিয়ে ভাববার মতো যথেষ্ঠ বোকা নয়! মরুক না লাখে লাখে মানুষ, পড়ুক না শয্যায় কোটিতে কোটিতে, নির্বাচনে জিততে হবে, জনসভায়ও লোকসমাগম বাড়াতে হবে। অর্থ আর অর্থের মালিক আজ ব্যক্তি, সমাজ, প্রশাসন, রাষ্ট্র, পৃথিবীর কাছে হয়েছে নমস্য। তার প্রমাণ মেলে লকডাউনকালীন খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতি আমাদের আচরণ দেখে। আমরা ঐ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর ত্রানের তেল-চাল-ডাল একদিকে গায়েব করে দিই অন্যদিকে তাদের ভ্যান রিক্সা আটকে উল্টাভাবে ঝুলিয়ে রাখি এর বিপরীতে কতটি মার্সিডিজ গাড়ীকে উল্টাতে দেখেছি সে হিসাব বের করতে স্বতন্ত্র গবেষণা প্রয়োজন যদিও করোনা ভাইরাসের সক্রিয় উপস্থিতি বিত্তবানদের তুলনায় খেটে খাওয়া মানুষদের মাঝে পাওয়া যায়নি বললেও চলে। এ তো গেল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের পুজিঁ তোষণের কথা। পুঁজিবাদ আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির চিত্র আরো ভয়াবহ।

ভারতে আজ যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় চলছে সেখানেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘মানবিকতার রাজনীতি’ মূখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভারত সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার জন্য অবদান রাখছেন এটা যেমন খালি চোখে মানবীয় মনে হতে পারে আবার তাদের সেই মানবিকতা নিয়ে প্রশ্নও জাগে পেছন ফিরে যখন দেখি এই সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং তাদের মিত্ররা সিরিয়া সংকটের অগ্রনায়কের দায়িত্বে রত, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক বিপর্যয়ে তারা দর্শকের ভূমিকায়। রাজনীতি বিশ্লেষকগণের অনেকেই তাই মানবিকতার চেয়ে এই দেশগুলোর ব্যবসায়িক বন্ধন আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের প্রভাবকে এই ঘটনার বড় প্রভাবক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যাহোক বা যেভাবেই হোক না কেন মানবীয় বিপর্যয়ের মোকাবেলায় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, ইরোপীয় ইউনিয়ন সহ উদ্যোক্তা দেশগুলোর প্রতি সাধুবাদ জানানোটাই কর্তব্য। এর বিপরীতে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের দোসরদের ভারতের এই দু:সময়কে সুযোগ হিসেবে নিয়ে ভয়ঙ্কর টিকা রাজনীতি, অর্থ লোলুপতা, প্রভাব বিস্তারের রাজনীতিও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যা দেখে হয়তো শয়তানদের আদিগুরু ইবলিশও শতবার লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছে!

অর্থ, ক্ষমতা, প্রভাব যে কতটা দুর্বল হতে পারে এই অদৃশ্য করোনা ভাইরাস আমাদের নিস্ক্রিয় বিবেককে আরেকবার জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এরপরও যদি আমরা না জাগি, মানবিকতার স্বরূপকে মেলে ধরতে না পারি, পুঁজির পূজা বাদ দিয়ে যদি মানবিক পৃথিবী গড়তে মনোনিবেশ করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের কতটা নিষ্ঠুরভাবে মূল্যায়ণ করবে সেটি সময়ের বিবেচনাবোধের উপর ছেড়ে দিতে হবে।

লেখক: বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সদস্য ও

পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :