আমার গর্বিত কৃষক আব্বা ও তাঁর কৃষি পেশা

প্রকাশ | ০১ মে ২০২১, ১২:৫৫

জব্বার আল নাঈম

আব্বা মারা গেছেন ১৬ রমজান, ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে। এই এক যুগ দীর্ঘ একটা সময়। তবুও আব্বাকে ভুলতে পারি না, কোনো সন্তানই তার বাবা-মাকে ভুলতে পারে না, ভুলে থাকা সম্ভবও না। প্রতিটি সন্তানই বাবার ছায়া অনুসরণ করে থাকে, যখন তিনি আর থাকেন না।

 

আমার আব্বা ছিলেন পৃথিবীর আদি পেশার একজন সফল মানুষ। যেই আদিপেশার মানুষেরা পৃথিবীর পালস ঠিক রাখেন। শত কষ্টে ধরে রাখেন গতি। যেমন, উত্তাল ঝড়ের দিনেও সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের হাল ছেড়ে দেন না কাপ্তান। আব্বা ছিলেন ওই অর্থে একজন কাপ্তান। অর্থাৎ কৃষক। একদম খাটি মানুষ ছিলেন। মাটির সঙ্গে যাদের সম্পর্ক তারা কখনই পরিবর্তন হন না, চাইলেই হতে পারেন না। সেই খাটি মানুষের রক্তই বইছে আমার শরীরে। তাই জীবনে নয়-ছয় বুঝি না। বুঝি মূল বা মৌলিক সত্ত্বা আঁকড়ে ধরে থাকা। কারণ, সেখানেই প্রাণ। প্রাণের উৎস। আরাম পাওয়া যায়, আনন্দ আসে মনে। সব মানুষই একটা সময় মূলের দিকে ফিরে। যেমন আমি বাঙালি এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। আমার জন্ম চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার নারায়ণপুর পৌরসভার বদরপুর গ্রামে। আমার পূর্ব পুরুষ মুসলমান, আমার বাপ-মা-ও মুসলমান, আমি তাদের ঔরসজাত। এটাও ভুলে যাবার উপায় নেই।

 

০২

জমির ফসল দেখলে খুশিতে চোখের হাসি বেড়ে যেত আব্বার। মন নেচে উঠত কোমলমতি বাচ্চাদের মতো। তিনি সন্তানদের যেমন যত্ন নিতেন একইরকমভাবে যত্ন নিতেন জমির ফসলের। সকালে ফজর আদায়ের পর জমির আইল ধরে হাঁটতে বের হতেন। আবার বাড়ি ফিরতেন, আবার যেতেন আবার বাড়ি ফিরতেন আবারও যেতেন। এতে আব্বার কোনো বিরক্তি ছিল না। অথচ আমরা ভাইবোনেরা বরাবরের মতো বিরক্ত হতাম। আব্বা বলতেন, সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বাবা-মায়ের। তেমনিভাবে মানুষের খাবারের দায়িত্ব হলো কৃষকের। কৃষি ও কৃষক যদি না থাকে পৃথিবীর কোনো পেশাই টিকবে না, মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়বে আরাম-আয়েশের জৌলস। আর সত্যিকারের কৃষক ফসলের যত্ন নিবেন সন্তানের মতোই।

 

একজন স্বর্ণকার নাকফুল বানাতে গিয়ে কত নিখুঁত ও নিপুনভাবে কাজ করেন। শিল্পের চূড়ান্ত উৎকর্ষতা দেখান। ধৈয্য ও সহ্য নিয়ে আস্তে আস্তে বানাতে থাকেন যেন প্রথম তাজমহল, অন্তত নাকফুলের নিপুণতা দেখলে তাই মনে হয়। জোরে হাতুড়ি পেটা করেন না, কারণ, সেটা নাকফুলে না লেগে হৃদয়ে লাগবে। ব্যাথায় আহতও হতে পারেন। মাটির এই দেহে হৃদয় না থাকলে যেমন সবকিছুই অনর্থক। এমন ভাবনা একজন স্বর্ণকারের।

 

স্বর্ণের খনিতে যারা কাজ করেন, তারা স্বর্ণকে স্বর্ণ বানাতে গিয়ে হাত থেকে রক্ত ঝরান। সেই শ্রমের কারণেই হয়তো স্বর্ণে এসেছে সোনালি রং। যা নারীর দেহে প্রতিনিয়ত শোভাবর্ধন করে চলছে। শুনেছি স্বর্ণের খনিতে পুরুষ শ্রমিকরা বেশি কাজ করেন। যারা শ্রম দিয়ে অলংকারে নান্দনিকতা বাড়ান, তারা নিজে আলোকিত ততটুকু নন। হয়তো সে-কারণেই পুরুষ স্বর্ণ পরিধান করে কম। যেভাবে কৃষক আঁকড়ে ধরে রাখেন না উৎপাদিত ফসল। বস্তাবন্দী করে পাঠিয়ে দেন দূর-দূরান্তে। মানুষের মুখের খাবার মুখে তুলে দিতে পারলেই খুশি হন কৃষক। সন্তান বড় হলে নিজের প্রয়োজনে, পরিবারের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে যেভাবে দূরে চলে যায়। খুশি হন বাবা মা।

০৩

পৃথিবীর সবচেয়ে আদি ও এলিট পেশার নাম কৃষি। আর যারা কৃষি কাজ করেন তারাই হলেন কৃষক। কৃষকরা মানুষের প্রাণ। তারা কখনই নিজের কথা ভেবে কৃষি কাজ করেন না। ভাবেন, দেশ ও দশের কথা। আমার আব্বাকেও তাই ভাবতে দেখতাম। বলতেন, কৃষি কাজ করলে শুধু যে ফসল পাওয়া যায়, ব্যাপারটা তা না। কৃষি থেকে শুধু যে মানুষের খাবার পাওয়া যায়, তা না। এই খাবার সব প্রাণীর খাবার। পোকা-মাকড়ের খাবার। সমাজের অবহেলিত ইদুর, বিড়াল ও কুকুরের খাবার। এর বাইরে কৃষকরা বড় একটা জিনিস উৎপাদন করে। আর তা হলো বিশুদ্ধ অক্সিজেন।

 

আব্বার কথার সঙ্গে আমি মিল খুঁজি ২০২১ সালে এসে। দিল্লিতে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মরছে। অক্সিজেন নেই। প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষ গড়ে ৫৫০ লিটার বা ১৯ কিউবিক ফুট বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ করে। সাধারণত বাড়িতে ব্যবহারের জন্য একটি সিলিন্ডারে এক হাজার ৪০০ লিটারের (১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটার) অক্সিজেন থাকে ৷ ব্যবহার করা যায় ১৮-২০ ঘণ্টা ৷ একটি সিলিন্ডারের রেগুলার দাম ১৫ হাজার টাকা। করোনাভাইরাসের এই সংকটকালীন সময়ে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে ৪০-৪৫ অথবা ৫০ হাজার টাকায়। প্রতি মিনিটে ৩ থেকে ৬ লিটার অক্সিজেন আমরা গ্রহণ করছি। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ সে হিসেবে কত টাকার অক্সিজেন ব্যবহার করেছে? তা যদি কিনে ব্যবহার করতে হত তার দশা কি হতো ভাবেন তো একবার। অথচ স্রষ্টা তা আমাদের জন্য ফ্রি করে দিয়েছেন।

 

আচ্ছা, এই অক্সিজেনের উৎস আসে কোথায় থেকে? ওই কৃষি থেকেই। অর্থাৎ আমার আব্বার পেশা থেকে। পৃথিবী অক্সিজেন শূন্য হলে মুহূর্তের মধ্যে আমরা নাই হয়ে যাব। তাই যে যার অবস্থান থেকে সবুজের খাদেম হোন। বেশি বেশি গাছ লাগান। পরিবেশ বাঁচান। নিজের অক্সিজেন নিজে সরবরাহ করেন।

 

বুঝলেন কেন বললাম কৃষি হলো পৃথিবীর সেরা পেশা। কৃষকরা হলেন আমাদের প্রাণ। এই প্রাণের মানুষগুলোকে প্রতিনিয়ত বুকে রাখার কথা ছিল আমাদের। আমরা সবচেয়ে বেশি অবহেলা করি কৃষি পেশাকে। ঘৃণা করি কৃষককে। উঁচু ও নরম চেয়াটায় তাদেরকে বসতে দেই না। প্রাপ্য সম্মানটুকু দেই না। অথচ প্রতিদিন তাদের পায়ে ধরে সালাম করলেও কম হয়ে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, উকিল, সচিব, সরকারের আমলা-কামলা, চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী। বড় বড় কথাবাজ যাই বলি না কেনো এসব থাকবে না কিছুই। তাই বলি, হে গদি দখলদারগণ, কৃষকদের সঙ্গে কখনই অন্যায় করবেন না। তাদের উপর অত্যাচার করবেন না। তাদের নায্য পাওনা বুঝে না পেলে তারাও প্রতিবাদের নামবেন। তবে সেই প্রতিবাদের ধরণটা হবে একটু ভিন্ন!

 

সংক্ষেপে বলি, একজন কৃষক জমিতে রক্ত-পানি ঢালার পরিবর্তে স্বপ্ন দেখেন ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, উকিল, সচিব কিংবা সরকারের আমলা-কামলা, চেয়ারম্যান অথবা এমপি, মন্ত্রী বানাবেন। এটা ভালো খবর সন্দেহাতীতভাবে। যদিও কৃষি ব্যবস্থার জন্য তা অশনি সংকেত। পৃথিবীর উন্নত দেশে বড় বড় চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে কৃষক-সন্তানরা। সমস্যাটা কোথায় হয়েছে জানেন, টাকায় আট মণ চালের পরিবর্ত এখন আট মণ চাল কিনতে হচ্ছে ২২,৪০০ টাকায়।

 

আগে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারা ১১ হাজার টাকা বেসিকে চাকরি করেও মাস শেষে হাতে টাকা থাকত। এখন ৮১ হাজার টাকা পেয়েও মাস শেষে থাকে ২১ হাজার টাকার ঋণ। এর পরও মনে নেই শান্তি। সংসারে নেই শান্তি। সন্তান ও স্বজনদের অন্তহীন অসুখ-অসুবিধা লেগেই আছে। সবচেয়ে বড় অসুবিধার কথাটা বললাম না, সেটা হলো বিশুদ্ধ শ্বাস-প্রশ্বাসের ঘাটতি। আরেকটু সহজ করে বললে অক্সিজেনের ঘাটতি। এরা যে কেবল অক্সিজেন দেয় তা না, আপনার কার্বন-ডাই-অক্সাইডটাও গ্রহণ করছে।

০৪

আব্বাকে নিয়ে সব সময় গর্ব করি আমি, তিনি শক্তিশালী একজন মানুষ ছিলেন বলে না, লম্বায় ৬ ফুট উঁচা ছিলেন বলেও না। একাত্তরের যুদ্ধে নিজের থাকার ঘরটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন বলেও না, আমাদের জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন সেজন্যও না। গর্ববোধ করি তিনি একজন কৃষক ছিলেন। ছিলেন মাটির মানুষ। এই শহরে এমন মানুষ এখন আর মিলে না। কেউ ডাক দিয়ে শুনতে চান না কারো হৃদয়র কথা । দুঃখের দিনে মাথায় হাত রেখে বলেন না, এগিয়ে যাও। এসব যে একেবারে নেই তা-ও না। মায়া আছে, কিন্তু মায়ার ভেতর যে গভীর মমত্ববোধ ও আন্তরিকতা তার কিছুই নেই। সৌজন্যতাবোধ আছে, কিন্তু এর সুভাস নেই।

 

তাহলে কোথায় পাবেন এসব? এক দুপুরে হঠাৎ করে কৃষকের ঘরে উপস্থিত হলে দেখা মিলবে এমন আন্তরিকতার। দেখবেন, ঘরে বিদ্যুৎ নেই, মাছ-মাংস নেই। ঘরের ভেতর ডেকোরেশন নেই। তবুও দেখবেন কমতি নেই সমাদরের। দেশি মুরগির একটি ডিম ভাজি করে, একটি পেয়াজ দিয়ে আপনার সামনে এনে দেবেন ভাতের প্লেট। এক গ্লাস দুধ তো থাকবেই। তা-ও পালিত গাভীর দুধ। মাংস নেই বলে অন্তর থেকে বারবার আপসোস করবেন কৃষক। আর বলবেন, আপনারা শহরে কত ভালো খাবার খান, আমি কিছুই করতে পারলাম না। বলতে বলতে কৃষকের বউয়ের হাতে বানানো পাখায় বাতাস করবেন। সেই বাতাসের কোমলতায় হারিয়ে যাবেন আপনি। বলবেন এটাই জীবন। সত্যিকারের জীবন। এই জীবন মানুষের।

 

আমার আব্বার রুহের মাগফিরাত কামনা করে সবাই দোয়া করবেন। তিনি যেন সুখে থাকেন। সুন্দর থাকেন। আর প্রত্যেকে বাবা-মায়ের যত্ন নেবেন। কারণ, বাবা-মায়ের চেয়ে আপনজন আপনার কেউ নেই। মনে রাখবেন, বাদবাকিরা প্রয়োজনে আপনজন হয়।

 

 

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক