টাঙ্গাইলের ১২ হাজার বাস শ্রমিকের মানবেতর জীবনযাপন

রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল
 | প্রকাশিত : ০১ মে ২০২১, ১৩:০২

প্রায় ৪০ বছর যাবত গণপরিবহনের সঙ্গে যুক্ত আছেন ৫৬ বছর বয়সী আব্দুস সামাদ। হেলপার থেকে সুপারভাইজার, তারপর চালক। ৩৫ বছর যাবত বাসচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। রাত দিন পরিশ্রম করে মাস শেষে আয় করতেন ২৫-৩০ হাজার টাকা। তা দিয়ে চলতো তার যাবতীয় সাংসারিক খরচ। করোনাভাইরাস বৃদ্ধি পাওয়ায় গণপরিবহন বন্ধ রেখেছে সরকার। গত ২১ দিন যাবত বাস চালাতে পারেন না তিনি। আয় রোজগার না থাকায় খুব কষ্টে দিন পার করছে। লজ্জায় কারো কাছে বলতেও পারেন না। কারো কাছে হাতও পাততে পারেননি।

আব্দুস সামাদের জমানো যা টাকা ছিল তা লকডাউন শুরুর প্রথম সপ্তাহেই শেষ হয়েছে। খুবই কষ্টে দিন পার করছেন তিনি। পানি-ভাত খেয়ে সাহরি ও ইফতার করছেন তার পরিবারের সদস্যরা। কর্মহীন বাসশ্রমিকরা অনেকটা বেকায়দায়।

শুধু আব্দুস সামাদ নয়, তার মতো টাঙ্গাইল জেলার বাস-মিনিবাসের ১২ হাজার শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। গত বছর লকডাউনে সরকারি বেসরকারি ত্রাণ সামগ্রী পেলেও এবারের লকডাউনে এখন পর্যন্ত মালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতি ও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি শ্রমিকরা। ফলে আগামী দিনগুলো কিভাবে পার করবেন তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা।

আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আগে প্রতিদিন রোজগার করতাম মোটামুটি ভালই চলতাম। এখন আয় রোজগার বন্ধ থাকায় খুব কষ্টে চলতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সপ্তাহে ৭০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয় সেই টাকাও নাই। পরিবহনে সেবা দেয়ার বেলায় সবার আগে কিন্তু সুযোগ পাওয়ার বেলায় সবার পেছনে। আমাদের ক্ষেত্রে কেউ এগিয়ে আসে না। সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতার দাবি করছি।’

সরেজমিন টাঙ্গাইল নতুন বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, পরিবহন শ্রমিকরা জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক সমিতির সামনে বসে আছেন। শ্রমিক নেতাদের কাছে তাদের কষ্টের কথা শেয়ার করছেন। শ্রমিক নেতাদের মাধ্যমে সরকারি বেসরকারি ও জন প্রতিনিধির কাছে ত্রাণের দাবি করছেন। আবার অনেক শ্রমিক তাদের বাস পরিষ্কার করছেন। কয়েক ডজন শ্রমিকের কাছে তাদের সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে তারা বলেন, উপরে ভালো আছি। কিন্তু ভিতরে খুবই কষ্ট। কাজ জানা সত্ত্বেও কাজ করতে পারি না। আয় রোজগার না থাকায় পরিবারের সদস্যরাসহ নিজেরা খুব কষ্ট করছি।

মজনু মিয়া নামে আরেক চালক বলেন, ‘গত ১৪ মাস যাবত আমার স্ত্রী স্ট্রোক করেছে। তার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখনও সপ্তাহে ৮০০ টাকা ওষুধ লাগে। এছাড়াও ছোট ছোট ছেলে মেয়ে আছে, তাদের পেছনে খরচ করতে হয়। প্রথমে মানুষের কাছে ধার দেনা করে চললেও এখন আর কেউ দিতে চায় না। সব মিলে খুব কষ্টে দিন পার করছি। যেভাবে চলছে এভাবে চলতে থাকলে আগামী ঈদে ছেলে মেয়েকে নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে পারবো না।’

জুয়েল খান নামে আরেকজন বলেন, ‘পৌর এলাকায় প্রায় তিন হাজার বাসচালক আমরা বাসা ভাড়া করে থাকি। লকডাউনের কারণে গত মাসের বাসা ভাড়াও দিতে পারি নাই। বাজার করার টাকা পকেটে নাই। বাসার মালিক ভাড়ার টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। খুবই কষ্টে দিন পার করছি।’

বাসের সুপার ভাইজার হিসেবে চাকরি করেন হারুন মিয়া নামে একজন। তিনি বলেন, ‘গাড়ি চললে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনো রকম চলতে পারি। কিন্তু গাড়ি বন্ধ থাকায় চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। গত বছর ত্রাণ সামগ্রী পেলেও এ বছর কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমাদের দেখার কি কেউ নেই।’

হেলপার হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমার ছয় মাসের সন্তান দুধ খাওয়াতে হয়। আয় রোজগার না থাকায় এখন সুজি খাওয়াচ্ছি। এর চেয়ে আর কি কষ্ট হতে পারে।’

চালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘জমানো টাকা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। সহযোগিতা চাইবো বলে অনেক মানুষ আমাকে দেখলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। টাকা ধার না দেয়ায় সুদের ওপর টাকা নিয়ে চলতে হচ্ছে। সুদের টাকা দিন দিন বাড়ে। এসব টাকা কিভাবে পরিশোধ করবো জানি না। খুবই মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।’

টাঙ্গাইল জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, ‘সমিতির আওতাভুক্ত আছে ছয় হাজার শ্রমিক। এ ছাড়াও সমিতির বাইরে আরো ছয় হাজার শ্রমিক রয়েছেন। বর্তমানে বাসের চালক, সুভারভাইজার, বুকিং মাস্টার ও হেলপারসহ গণপরিবহনের সঙ্গে জড়িত সবাই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গত বছর সরকারি বেসরকারিভাবে চার দফায় পাঁচ হাজার শ্রমিককে সহযোগিতা করেছিলাম। শ্রমিকদের সহযোগিতার জন্য জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, পৌর মেয়র, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউএনওসহ বিভিন্নজনের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কারো কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।’

তিনি বলেন, ‘লকডাউনের কারণে সমিতির আয় রোজগারও নেই। সমিতির সম্পদ বিক্রি করা ছাড়া সমিতির পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার সামর্থ নেই।’

সমিতির সভাপতি আহসানুল ইসলাম পিটু বলেন, ‘গত বছর সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তির সহযোগিতায় শ্রমিকদের ত্রাণসামগ্রী দেয়া হয়েছে। এছাড়াও সমিতির উদ্যোগে ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হয়েছিলো। এ বছর এখন পর্যন্ত শ্রমিকরা কোন সহযোগিতা পায়নি। ইতিপূর্বে ত্রাণসামগ্রীর দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণের আশ্বাস দেয়ায় মানববন্ধন করা হয়নি।’

জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির মহাসচিব গোলাম কিবরিয়া বড় মনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস ও লকডাউনে গণপরিবহন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। পরিবহন শ্রমিকদের দ্রুত আর্থিক সহায়তার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এর ফলে বাস মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত। অনেক মালিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাস কিনেছেন। পরিবহন বন্ধ থাকায় তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত বাস মালিকদের সরকারি প্রণোদনা দেয়ার দাবি জানান।

(ঢাকাটাইমস/০১মে/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :