সরকারের দিকে তাকিয়ে হেফাজত

প্রকাশ | ০৬ মে ২০২১, ১৯:২০

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

হেফাজতের আগের কমিটির নেতাদের অনেকেই এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। নতুন ও পুরাতন মামলায় প্রায় প্রতিদিন সংগঠনটির নেতাদের কেউ না কেউ গ্রেপ্তার হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাতে। গতকালও আটক হয়েছেন একজন কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি বিলুপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় গত মার্চে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে গত এক মাসে হেফাজতের ডজনের বেশি নেতা আটক হয়ে এখন কারাগারে। গ্রেপ্তার আতঙ্ক হেফাজতের অন্য নেতাদের মধ্যে। এমনকি সংগঠনের প্রধান ব্যক্তি জুনায়েদ বাবুনগরীকে নিয়েও ভয়ে আছেন নেতারা।

এই পরিস্থিতিতে সরকারের আনুকূল্য পেতে তাকিয়ে আছে হেফাজত। হেফাজতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ঠেকাতে এবং আটক নেতাদের মুক্তির জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এরই মধ্যে দুই দফা বৈঠক করেছে হেফাজত। কিন্তু সরকারের তরফে তেমন কোনো আশার আলো দেখতে পাননি তারা। বরং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থার কথা জেনেছেন তারা। 

২০১০ সালের সরকারের নারী নীতিমালার বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক আহমদ শফীর নেতৃত্বে এ সংগঠনটির জন্ম হয়। সে সময় ১৩ দফা দাবি সামনে রেখে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ করেছিল। আর দেশজুড়ে সংগঠনটির উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে।

হেফাজত ব্যাপক আলোচনায় আসে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থানের পর। ওই দিন ঢাকায় বিপুল তাণ্ডবের ঘটনা প্রত্যক্ষ দেশবাসী। এ ঘটনায় একাধিক মামলা করে পুলিশ। সেবার অবশ্য সরকার হেফাজতের দিকে সহানুভূতির হাত বাড়ায়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে বেশি এগোয়নি। গ্রেপ্তার নেতাদের দ্রুতই মুক্তির ব্যবস্থা করে। গ্রেপ্তারের উদ্যোগও বন্ধ রাখে। সেবার এমনকি হেফাজতের অনেক দাবি, যেগুলো সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল, তা পুরণ করা হয়। দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। 

এরপর হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্ক ভালো ছিল। আহমদ শফীর কাছে সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যাতায়াতও ছিল।

আহমদ শফির মৃত্যুর পর নানা বিতর্কিত ঘটনায় হেফাজত ইসলাম আবার আলোচনায় আসে।  সম্প্রতি মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের বিক্ষোভ, তাণ্ডব ও সংঘর্ষে ১৭ জন মানুষ মারা যায়। হেফাজতের লাগাতার তাণ্ডবে কঠোর হয় সরকার। মামলা, গ্রেপ্তার এবং সরকারি মহলের নানামুখী চাপে নজিরবিহঅন কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছে হেফাজতে ইসলাম।

গত ১৮ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সেক্রেটারি মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে ১১ এপ্রিল কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী গ্রেপ্তার হন। পরদিন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর সহ-সভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদীকে কেরাণীগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

১৩ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন হেফাজতে ইসলামের সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরীফ উল্লাহ। একই দিনে হেফাজতে ইসলামের নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুফতি বশির উল্লাহ গ্রেফতার  হন।

সহকারী মহাসচিব মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজী গ্রেপ্তার হন ১৪ এপ্রিল। একই দিন গ্রেপ্তার হন কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি।

হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর সহ-সভাপতি মাওলানা যুবায়ের আহমদ ১৬ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন। পরদিন গ্রেপ্তার হন কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন। একই দিন সংগঠনটির ঢাকা মহানগরীর সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিবীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২১ এপ্রিল হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সহ সভাপতি আল্লামা খুরশিদ আলম কাসেমীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ। সেদিন রাতে গ্রেপ্তার হন কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন। ২২ এপ্রিল ভোরে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন সংগঠনটির যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী।

২০ এপ্রিল ঢাকা মহানগর সহ-সভাপতি মাওলানা কুরবান আলী, ২২ এপ্রিল ঢাকা মহানগরীর কার্যনির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা সানাউল্লাহ, একই দিন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ঢাকা মহানগরে সহ-দফতর সম্পাদক ও ইসলামী ছাত্র সমাজের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা ইহতেশামুল হক সাখী, পরদিন হেফাজতে ইসলামের দাওয়াহ সম্পাদক মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী, ২৩ মার্চ গ্রেফতার হন দলটির নেতা আল্লামা মুফতি নূর হোসাইন নূরানী। এছাড়া দলটির শীর্ষ পর্যায়ের আরও বেশ কিছু নেতা পুরনো ও সাম্প্রতিক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।

মামলা ও গ্রেপ্তার রুখতে গত ১৯ এপ্রিল রাতে হেফাজতের সাবেক কমিটির মহাসচিব ও বর্তমান আহ্ববায়ক কমিটির সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদীসহ কয়েকজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে তাতে কোনো ফল আসেনি।

গত মঙ্গলবার রাতে আবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে অন্তত দুই ঘণ্টা বৈঠক করেছে সংগঠনটির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল। সেখানে হেফাজতের নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী, সদস্য মুহতামিম মিজানুর রহমান চৌধুরী, বিলুপ্ত কমিটির উপদেষ্টা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জীসহ পাঁচ নেতা উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় তারা চার দফা দাবি তুলে ধরেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। ১. হেফাজতের গত আন্দোলনকে কেন্দ্রে করে সারাদেশে গ্রেফতারকৃত আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলিমদের মুক্তির ব্যবস্থা করা।

২. দেশব্যাপী গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকায় পবিত্র রমজান মাসে ইবাদত-বন্দেগি করতে না পেরে অজানা আতঙ্কে দিন পার করছে আলেম–ওলামা ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ। গ্রেপ্তার-আতঙ্ক ও হয়রানি থেকে তাদের মুক্তি দেয়া। বিশেষ করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় গণগ্রেপ্তারের আতঙ্কে মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসে আলেম-উলামা ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের হয়রানি বন্ধ করতে আপনার নিকট বিশেষ আনুরোধ জানাচ্ছি।

৩. ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীদের নামে যে সকল মামলা হয়েছিল, পূর্ব আলোচনা অনুযায়ী সে মামলাগুলো প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা।

৪. বর্তমান পরিস্থিতিতে কুরআন হাদিদের শিক্ষাকেন্দ্র কওমি মাদরাসাগুলো সরকারের নির্দেশে  বন্ধ হয়েছে। আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য পূর্বের ন্যায় এগুলো দ্রুত খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা।  

তাদের এসব দাবির বিষয়ে এখনো সরকার কিছুই ভাবছে না বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, হেফাজত যে দাবি জানিয়েছে তা নিয়ে সরকার এখন কোনো চিন্তা করছে না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, আগেও হেফাজতকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তারা এই সুযোগে নাশকতা এবং বিভিন্ন অরাজকতা তৈরি করেছে। এবার এই নিয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চায় না সরকার।

এ বিষয়ে হেফাজতের সাবেক কমিটির এক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা টাইমসকে তিনি জানান, দলের শীর্ঘ পর্যায়ের নেতারা সরকারের কাছে তাদের দাবির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ওই নেতা আরও বলেন, ‘মুরব্বিরা সরকারের সঙ্গে বসছেন। তারা আলোচনা করেছেন। আলোচনা এখনো চলছে। এখনো কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমরা জানতে পারিনি।’

এক প্রশ্নের জবাবে সংগঠনটির আরেক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আন্দোলনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। এমন কিছু আমাদের জানানো হয়নি। আমরা এখন অনেকটা নিশ্চুপ রয়েছি। সরকারের সঙ্গে আমির সাহেবসহ মুরব্বিদের আলোচনা হচ্ছে। সেখান থেকে আমার জানামতে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সরকার কি সিদ্ধান্ত দেয় আমরা সে অপেক্ষায় আছি।’

ঢাকাটাইমস/০৬মে/কারই/মোআ