লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স, বেওয়ারিশ কুকুর ও ঘণ্টাখানেক সময়!

হাফিজুর রহমান রিয়েল
 | প্রকাশিত : ০৬ মে ২০২১, ২১:০৩

রাত সোয়া এগারোটা ক্রস করেছে তখন। হলি ফ্যামেলির সামনে থামলো গাড়ি। স্রেফ একটু আড্ডা দেওয়ার জন্য দাঁড়ালাম আমি, ইমরান, মুহিত আর মিজান। বেশ মনজুড়ানো ঠাণ্ডা বাতাস। সবুজ পাতাগুলো দুলছে হাসিমুখ কিশোরীর মতো। একটা চায়ের দোকান খোলা আছে।

চা বানানোর টুংটুং শব্দটা বেশ ঠেকছে কানে। চা দোকানির মুখে মাস্ক নেই। পান খাওয়া দাঁতগুলোতে যেন বেল রঙের প্রলেপ। একজন লোক সিগারেট কিনতে এসেও কিনলেন না, শুধু চা দোকানির মাস্ক না থাকায়। এ নিয়ে পেছন থেকে চা দোকানির টিপ্পনি শুনলাম- ‘মাস্ক-টাস্ক পইড়া কি হইবো, খোদায় যেদিন ডাক দিবো, চইলা যামুগা’।

পাশ থেকে চা-পানরত একজন রিকশাওয়ালা বললেন-‘আপনের টেরা-টোরা কথা গুলান যাইবো না হারা জীবন, করোনাটা হইলে টের পাইবেন’। চা দোকানি হো হো করে হেসে উঠলেন। এই হাসির মধ্যে আনন্দ-দুঃখ-হাহাকার আর কান্নার সাথে কিসের যেন একটা আক্ষেপও জড়িয়ে আছে মনে হলো।

একটু অদূরে সারিবেঁধে রাখা আছে কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স। সারির প্রথম অ্যাম্বুলেন্সের ডান দরোজাটা খোলা। ড্রাইভিং সিটে বসে নোয়াখালীর ভাষায় কারও সাথে ফোনে কথা বলছেন চালক। বুঝতে গিয়ে ক্ষাণিক ধাক্কা খেলাম। যেটা বুঝলাম তা এরকম- ‘আঁই আর ন পারি লাশ টাইনতে, আঁই বিরক্ত হই গেছি’। অতিমারি আখ্যানের এই সময়ে এই ক’টি কথা যেন আমাদের সবার মনের-গহীনের-একান্ত অনুভব শূন্যতার মাঝখানে নৈরাশ্যের অব্যক্ত উচ্চারণ।

ঝিরিঝিরি বাতাসটার বেগ একটু বাড়ল। জায়গাটা একটু শুনশান হয়েছে আগের চেয়ে। সচিব কোয়ার্টারের গেটে একটা বেওয়ারিশ কুকুর মাথা নিচু করে শুয়ে আছে। একটু আগে একজন একটা পাউরুটি দিলেও খায়নি কুকুরটা। বেশ বিষণ্ণ মনে হলো। কুকুরটার সামনের ভ্যানে একজন লোক আধাশোয়া হয়ে গা এলিয়ে আয়েশ করে সিগারেট টানছেন। খুব ক্লান্ত মনে হলো উনাকে।

ভদ্রলোকের নাম কামাল হোসেন। বাড়ি ভোলার বোরহানুদ্দিন উপজেলায়। লাশবাহী ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স চালান। আজকেও দুটি লাশ বহন করেছেন। একটু আগেই এখানে এসেছেন বিশ্রাম নিবেন বলে। এভাবে প্রতিদিন লাশ দেখতে আর ভালো লাগে না তার। বললেন- ‘এই করোনাভাইরাস কবে যাবে বলতে পারেন ভাই? যাওয়ার সময় কি হয়নি এখনো? আর ভালোই লাগছে না একদম, জীবন্ত মানুষগুলো লাশ হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন, কোন দিন যে কে সাদা কাপড় নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে উঠবে কে জানে; মাফ করো আল্লাহ।

আমি নিরুত্তর থাকি। ভ্যানের সামনে থাকা বেওয়ারিশ কুকুরটা দেখি মাথাটা আরও নিচু করে একদম নিঃসার হয়ে চুপ করে আছে। কার কী ভাবনা? কে কার মন বুঝে? কে জানে?

লেখক: অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা