আমরা কী ভারতের সিংহের চেয়েও শক্তিশালী!

প্রকাশ | ০৭ মে ২০২১, ১১:৫৫

আলম রায়হান

আমাদের সেতুমন্ত্রী বছরখানেক আগে বলেছিলেন, আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। সন্দেহ নেই, রাজনীতিতে কথাশিল্পী হিসেবে পরিচিত সাবেক সাংবাদিক, সরকারের মন্ত্রী এবং অন্যতম নীতিনির্ধারক ওবায়দুল কাদের এটি বলেছিলেন কথার কথা হিসেবেই। যদিও গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে সংবেদনশীল বিষয়ে নিয়ে ‘কথার কথা’ বলা সংগত কি না তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু কোনোই বিতর্ক নেই, আমাদের প্রতিবেশী ও ’৭১ সাল থেকে চিরকালের বন্ধু ভারত করোনায় মহাবিপর্যস্ত।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে কয়েক দিনে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে শীর্ষে আছে ভারত। ২৪ ঘণ্টার হিসেবে দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ লাখ ১২ হাজার ৬১৮ জন। এ সময়ে মারা গেছেন ৩ হাজার ৯৮২ জন। আর এটিই একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড। ভারতে দলে দলে মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ধারায় সংযুক্ত হয়েছে বনের রাজা সিংহ। যদিও তা রয়েছে চিড়িয়াখানার খাঁচায়। খাঁচায় থাকলেও তা তো সিংহ, বলশালী প্রাণী।

ভারতের হায়দরাবাদের নেহরু জুলজিক্যাল পার্কে সিংহের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। সম্প্রতি সেখানে ২৫ জন কর্মচারীর করোনা ধরা পড়ে। এর আগে নিউইয়র্কের ব্রংস চিড়িয়াখানায় আটটি বাঘ ও সিংহের শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। হংকংয়ে কুকুর, বিড়ালও আক্রান্ত হয়েছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, মানুষের থেকে পশুদের মধ্যে কি করোনা সংক্রমণ ছড়াচ্ছে? আর যদি ছড়ায় তা হলে কি তা আরো ভয়াবহ রূপ নিয়ে পশুদের থেকে মানুষের মধ্যে ফের সংক্রমণ ঘটতে পারে? ভারতের হায়দরাবাদের চিড়িয়াখানায় আটটি এশিয়ান সিংহ করোনা পজিটিভ হওয়ার পর এই প্রশ্নগুলোই এখন বিজ্ঞানীদেরকে নতুন ভাবনায় ফেলেছে।

এদিকে মানতেই হবে, এসব ভাবাভাবী থেকে আমরা বেশ মুক্ত। শুধু তাই নয়, আছি সম্ভবত ফুরফুরা মেজাজেও। আর অনেকেই হয়তো ভাবছেন, করোনা আসলে বাংলাভাইর মতো এক ধরনের প্রচারণা; বাংলাভাই ছিল মিডিয়ার, আর করোনাভাইরাস হচ্ছে সরকারের প্রচারণা। এমনটা না ভাবলে সরকারের এত সাবধানবাণী, লকডাউন থেকে ‘কঠোর’ লকডাউন- তারপরও এত মানুষ কেন রাস্তায়। শপিংমলে কেন এত ভিড়। অবশ্য কথিত কঠোর লকডাউনের মধ্যে শপিংমল কেন খোলার আনুমতি দিল সরকার, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। হতে পারে ব্যবসায়ীদের চাপ রয়েছে। আসলে সব দেশেই ব্যবসায়ীরা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মানবিক দিকটা সম্ভবত বেশ কম। অনেকটা ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির মতো, কেবল প্রাপ্তির বাসনা। এই ব্যবসায়ীরা সরকারকে চাপে রেখে কেবল সুবিধা নেবে- এটি ধরেই নেয়া যায়। কিন্তু কোন চাপে পড়ে পঙ্গপালের মতো মানুষ শপিংমলে যাচ্ছে, এই করোনাকালে! শুধু তাই নয়, নিয়ে যাচ্ছে পরিবারের শিশু সন্তানটিকেও। পেটে সন্তান, হাঁটতে কষ্ট হয়; তবু শপিংমলে হাসিমুখ ললনাদের সংখ্যাও কম নয়।

এ সব দেখে কে বলবে, করোনাভাইরাস বলে বাস্তবে কিছু আছে! এদিকে প্রতিদিনই দেশে বাস্তব লাশ হয়ে করোনার রোগী যাচ্ছে কবরে, শ্মশানে। এরপরও জনগণের হুঁশ হচ্ছে বলে তো মনে হয় না। বরং লকডাউনের বিরুদ্ধে নানান ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করে থানকুনি পাতা খেলে করোনা থেকে মুক্ত থাকা যাবে, সেই দেশের মানুষ অনেক কিছুই বিশ্বাস করতে পারেই। 

কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না করোনার ভয়াবহতাকে। অনাহূত মেহমান দখলদার বনে যাবার মতো করোনাভাইরাস বেশ জেঁকে বসেছে  এবং এটা এসেছে বিদেশ থেকে। বোরাক নয়, বাহন মানুষ।  গত বছর মহামারি দেখা দেওয়ার পর বিদেশ ফেরতদের প্রয়োজনীয় মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এরা ঝুড়ির ব্যাঙ্গের মতো কেবল লাফালাফি করেছে, কোয়ারেন্টাইনে থাকতে চায় না, ঘরে তো থাকতেই চায় না। সে এক গোলমেলে অবস্থা। শুধু তাই নয়, বিশেষ বিমানে চীন থেকে আনা হয়েছে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদেরকে। কিন্তু বিদেশ থেকে তো কেবল মানুষ আসেনি, সঙ্গে এসেছে করোনাভাইরাসও। এরপরও স্বীকার করতেই হবে, প্রথম ঢেউ সামাল দেয়া গেছে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে অধিকতর দক্ষতায়। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউর ব্যাপারে আগে থেকেই লাগাতারভাবে সাবধান করা হলেও মানুষ কী কারণেই যেন গায় লাগাচ্ছে না।  আমেরিকা-ব্রাজিলের উদাহরণও তেমন হালে পানি পেলো না। বরং এক শ্রেণির লোক বলতে শুরু করলো, এটি উন্নত দেশে আসমানী গজব এবং তা সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে!

প্রতিবেশী ভারত যখন বিপর্যস্ত করোনায়, হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, পার্ক ও উন্মুক্ত স্থানে স্থাপন করতে হয়েছে গণচিতা, এরপরও চিতার জন্য লাইনে রাখা লাশ খায় কুকুরে। তখনও আমাদের দেশের মানুষ রাস্তায় জটলা করে, চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়, গুলতালী মারে। রাজা-উজির তো মারেই। শপিংমলে হামলে পড়ে। গাদাগাদি করে ফেরি পার হয়, স্পিডবোটে মুরগি ঠাসা হয়ে নদী পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ দেয়। মানতেই হবে, বুকে সাহস আছে এই জাতির!

তবে কথিত এই সাহস আমাদেরকে কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে তার উদাহরণ কিন্তু ভারত। আমাদের মতো প্রতিবেশী নেপাল এর মধ্যেই টের পেতে শুরু করেছে, ভারতীয় ভাইরাস কত ভয়াবহ। নেপাল প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো ভয়াবহ করোনার সংক্রমণের মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন দেশটির চিকিৎসকরা। এরই মধ্যে ভারতের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে উদ্বেগজনক হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং হাসপাতালে শয্যা ও অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের উত্তর প্রদেশের সীমান্তবর্তী লুম্বিনি প্রদেশের বাঙ্কে জেলার ভেরি হাসপাতালের চিকিৎসকরা সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনায় ‘মিনি ইন্ডিয়া’ বলেছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ওই এলাকাগুলোতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেছেন, আমরা অসহায় অবস্থায় আছি।

ভারতের করোনা পরিস্থিতি কেবল প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য আশঙ্কা নয়, উদ্বিগ্ন করেছে সুদূরের দেশগুলোকেও। এই উদ্বেগ থেকেই অস্ট্রেলিয়া ভারত থেকে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলেও না। শুধু তাই নয়, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকরাও যদি ভারত থেকে দেশে ফেরে, তাহলেও জেল-জরিমানা অনিবার্য। হতে পারে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদ- এবং ৩৭ হাজার পাউন্ড জরিমানা। 

এদিকে আমরা! বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া যাত্রীরা বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন। এই ভারত ফেরত বাংলাদেশিদের কোয়ারেন্টাইনে হিমশিম খাচ্ছে যশোর প্রশাসন। যশোর ও বেনাপোলের ২৯টি আবাসিক হোটেল এখন কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। এ হোটেল ও বক্ষব্যাধি হাসপাতাল এবং অন্যান্য স্থানে কোয়ারেন্টাইনে ভারত ফেরত বাংলাদেশির  সংখ্যা সহস্রাধিক। এছাড়া সাতক্ষীরা, খুলনা, ঝিনাইদহ ও নড়াইলের হোটেলগুলোও কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে রূপান্তর করা হয়েছে। এ তালিকা হচ্ছে দীর্ঘ । সেই সাথে অনেকের দেহে মিলছে করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্ট। এরপরও স্বাস্থ্য বিভাগের মুখপাত্র বলছেন, আরো কিছু দিন সময় লাগবে। হায়, কোথায় যাচ্ছি আমরা! 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক