স্বপ্ন যখন যেত বাড়ি

প্রকাশ | ১২ মে ২০২১, ১৫:১৮ | আপডেট: ১২ মে ২০২১, ১৬:১৫

রবিউন নাহার তমা

রমজানের ওই রোজা এখন শেষের পথে। বছর ঘুরে আবার চলে এসেছে খুশির ঈদ। প্রতিবছর ঈদ আসে খুশির বার্তা নিয়ে। নতুন নতুন পরিবেশে নতুন করে কেটে যায় আনন্দময় একেকটা ঈদ। তবে শৈশব-কৈশোরে সবাই মিলে একসাথে ঈদ করার দিনগুলোর কথা যেন ভোলা যায় না। ঈদের এই কয়েকটা দিন আগে টিভিতে ঘরমুখো মানুষের খবর শুনে আর নিউজফিডে তাদের ছবি দেখে পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। ফিরে যাই সেই আনন্দে ভরা ভাবনাহীন রঙিন দিনগুলোতে।

প্রায় দেড়যুগ আগের কথা। স্কুলে পড়ি তখন। ঈদের আগের দিন আমরা গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। বর্তমানের অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস তখন সম্ভবত পদ্মা এক্সপ্রেস ছিল। যাদের বাড়ি ময়মনসিংহ জামালপুর এসব এলাকায় তারা অনেকেই এই ট্রেনের সাথে সুপরিচিত। গন্তব্য টাংগাইল। বাসে করে গেলে যেখানে ঢাকার পর গাজীপুরের একাংশ পার হলেই টাংগাইল সেখানে আমরা যাচ্ছি ট্রেনে। ঢাকা, গাজীপুর, পুরো ময়মনসিংহ জেলা, তারপর জামালপুর পার হলে টাংগাইল! তিনঘণ্টার জার্নি আটঘন্টা করার একটাই কারণ-সবাই একসাথে বাড়ি যাব! স্টেশনে গিয়ে সেলফি তোলা হলো না। তখন স্মার্ট ফোনই ছিল না আর সেলফিতো দূরের কথা। একজনের হাসিমুখই তখন আরেক জনের মুখছবি।

আমরা তিনবোন আর সাথে মামাতো ভাই। আমরা কমলাপুর থেকে, লিজা লিউনারা ময়মনসিংহ থেকে আর আব্বা-আম্মা ও দুইবোন উঠবে জামালপুর থেকে। হুলস্থুল আবস্থা! কি মজাটাই না হবে! ছোটকাক্কু আগেই রেলওয়ে পাশ দিয়ে রেখেছেন। দৌড় প্রতিযোগিতায় কখনো প্রথম তিনজনের মধ্যে না থাকলেও ট্রেন ধরার ব্যাপারে খুব এক্সপার্ট ছিলাম। তাই নির্দিষ্ট বগি খুঁজে সিটে জায়গা দখল করার দায়িত্বটা আমার উপরেই ছিল। কিন্তু ট্রেনে উঠেই বা কি লাভ? আমি উঠেছি দরজা দিয়ে,আমার আগেই আরো অনেকে উঠে গিয়েছে জানালা দিয়ে! বেদখলকৃত সিট পাশ দেখিয়ে অতঃপর বসা গেল।

ট্রেনের একটা মজার ব্যাপার ছিল যে গ্রামের মধ্যে দিয়ে যখন ট্রেন ছুটে চলে তখন জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যায় কখনও একদল শিশু হইহই করে আমাদের দিকে দিকে হাত নাড়াতো,কখনও দুষ্টু টাইপ ইয়াং ছেলেরা হাই-হ্যালো করত অথবা বয়স্ক মানুষেরা হাসিমুখে তাকাত। সবার যেন একটাই ভাষা-"ভালোভাবে যাও, খুশিমনে ঈদ করো''।

তো ট্রেনে উঠেই স্টেশন গোনা শুরু! এই টঙ্গী, এরপর জয়দেবপুর,কখন আসবে ত্রিশাল-গফরগাঁও তারপর ময়মনসিংহ...! টানটান উত্তেজনা। লেট করা ট্রেন সাড়ে বারোটার জায়গায় সাড়ে তিনটায় যখন ময়মনসিংহ এলো মনে হল যাত্রী হয়তো নেমে যাবে।কিন্তু কোথায় কি!মনে হয় পাঁচ মিনিটের মধ্যে যাত্রী আরও বেড়ে গেল! ট্রেনের ছাদে,দরজায় কমলাপুর থেকেই যাত্রী বোঝাই এখন আবার এ ওকে ধরে বাদুড়ঝোলা হয়ে চলা শুরু করল। কি অবস্থা! কিন্তু কারো মুখে যেন কষ্টের লেশমাত্র নেই। হাসিতে ভরা প্রতিটা মুখ। অবশেষে জামালপুর স্টেশনে আসার পর ট্রেন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! অর্ধেকের বেশি যাত্রী নেমে গেল আর আব্বা আম্মাও বাকি দুই বোনকে নিয়ে উঠল। এখন আরও মজা। ট্রেনের বগিতে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এবার হাত পা ছড়িয়ে বসার পালা। ইতোমধ্যে মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে। আমাদের কারও কাছে ফোন ছিল না। আব্বা ওঠার পর সবাই মিলে একটা ফোনের মালিক হলাম! ওদিকে গ্রামের আত্মীয় স্বজনদের মাঝে শুধু নজরুল দাদার ফোন আছে। তারাকান্দির কাছাকাছি আসার পর দাদা কল দিলেন। রিসিভ করতেই-কিরে কই তোরা? আসবি না!

সবাই একসাথে চাঁদরাত পালন করব।

আহ! সেই চাঁদরাত ...!

তবে আমাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সবচেয়ে মজার স্মৃতিটা তারও চার-পাঁচ বছর আগে। বাবা-মা,চাচা-চাচী আর সাথে ভাইবোন মিলে চোদ্দ-পনের জন ছিলাম আমরা। ছোট কাক্কু রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার হওয়া স্বত্তেও একটা সিটও পাইনি আমরা। ট্রেনের একদম শেষ বগির পেছনে যেদিকে দুই দরজা দিয়ে দুইপাশে মানুষ নামে ওখানে ছোট কাকীর শাড়ি বিছিয়ে আমরা বাচ্চারা বসে ছিলাম আর বড়রা দাড়িয়ে ছিলেন। সারাটা পথ হইচই আর গান গাইতে গাইতে পার হয়েছিলাম। যাত্রার কষ্ট একদমই টের পাইনি।

এত আনন্দের ঈদ শেষ করে ঢাকা ফেরার সময় আমাদের চেহারার দিকে তাকানো যেত না। ভ্যানে করে বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য রওনা দিলে গ্রামসুদ্ধ মানুষ বিদায় দিতে আসতো। বিশেষ করে দাদী-নানীরা তাদের বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর নিয়ে যেভাবে ভ্যানের পেছনে পেছনে এগিয়ে আসতো তা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে খুব কষ্ট হত।

একটা অনুভূতির কথা আজও মনে পড়ে। গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার সময় খুব কান্না পেত। বাসে ওঠার পর থেকেই একটু পর পর বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতাম আর ভাবতাম এখানে যদি বাস আমাকে নামিয়ে দেয় তবে আবার ফিরে যেতে পারব। এভাবে চলতে চলতে যখন উত্তরা-আবদুল্লাহপুর দৃষ্টিতে আসা শুরু করত। বুঝতাম,এখন বাস থেকে নামিয়ে দিলেও আর গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতে পারব না। তখন ক্লান্ত হয়ে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। ফেরার পর কয়েকদিন যে কি খারাপ লাগতো। কিন্তু বিগ সিটি বিজিনেস বলে কথা! দ্রুতই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতাম। তবে ভেতরে ভেতরে আবার ৩৬৫ দিন পরে আবার সেই বাড়ি যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা চাপা পোড়ে থাকত।

আমাদের বর্তমান সন্তানদের যে দাদা-দাদী,নানা-নানীর প্রতি মমতা নেই তা বলব না, কিন্তু সেটা গাছের ডাল আর শাখা-প্রশাখার মতো লাগে। আসলে ওদের দুর্ভাগ্য যে ওরা অনেকেই হয়তো বয়স্ক মানুষদের স্নেহ,তাদের হাত বুলিয়ে দেয়ার মধ্যে যে কি পরিমাণ মমতা আর দোয়া মিশে রয়েছে তা দেখার বা বোঝার সুযোগ বা অবসর কোনটাই হয়তো পায়নি। সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার সুবাদের প্রতিবছর হাজারো শিক্ষার্থীকে একদম কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। এর মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী শ্রমিক-দিনমজুর পরিবার থেকে উঠে আসে। ওদের কেউ কেউ দাদী বা নানীর সাথে স্কুলে আসে। হাসি-কান্না আর আবদার মিশ্রিত ওই সম্পর্কগুলো দেখে শেকড় থেকে উঠে আসা গাছের মেলে দেয়া শাখা-প্রশাখার মিল খুঁজে পাই। শৈশব-কৈশোর কালের কথা মনে হয়। দুপুর বেলায় কখনো বটগাছের ছায়ায় বসেছেন? ঘন পাতার আবরণ ভেদ করে রোদের সামান্য তাপও যেমন গায়ে লাগে না, প্রবীণ মানুষগুলোর আদর স্নেহও ঠিক সেরকম। যারা পায়নি তারা সত্যিই দুর্ভাগা।

এখন সেই বাড়ি আছে, আরও আত্মীয়-স্বজনও আছে, নেই শুধু আমাদের বটছায়ার মতো আগলে রাখা মানুষগুলো। বাড়ি গেলে স্নেহের বড় অভাব বোধ হয়। তাই নাড়ী এখন আর আগের মতো টানে না।

ঈদে বাড়ি ফেরার যে কি আকুতি, নাড়ীর যে কি টান তা কখনো যারা অনুভব করার সুযোগ পায়নি তারা বুঝবে না মানুষকে কোনো বাঁধা দিয়ে আটকে কেন রাখা যায় না। প্রতিবছরই ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। 'ঈদের সুখ' হয়ে যায় 'ঈদের  শোক'। তারপরও মানুষ সুতোর টানে ফিরে যায় এবং যাবেও।

ঢাকাকে কিছুদিনের জন্য নিস্তব্ধতার নগরীতে পরিণত করে রেখে যাওয়া মানুষগুলোর  ঈদ আনন্দময় হোক। সবাই আল্লাহর হেফাজতে নিরাপদে আবার ফিরে আসুক। শুভকামনা। অগ্রীম ঈদের শুভেচ্ছা।

লেখক: শিক্ষক

ঢাকাটাইমস/১২মে/এসকেএস