করোনা ভাইরাস বনাম বিশ্বাসের ভাইরাস

প্রকাশ | ১২ মে ২০২১, ১৮:০৪

আমিনুল ইসলাম

মহামারির ইতিহাসে এ বছরের কুম্ভমেলা বৃহত্তম  সুপার স্প্রেডার হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকবে- ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ডীন আশীষ জি এমনটিই বলেছেন।

কুম্ভ মেলা যেখানে হয় সেই উত্তরাখণ্ড রাজ্যের বিজেপি নেতা তিরাত সিং কুম্ভ মেলায় আগত ও সারা বিশ্ব থেকে আসতে ইচ্ছুক পুণ্যার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, কোভিড এর ছুতায় কেউ আপনাদের বাধা দিবে না, আমরা নিশ্চিত ইশ্বরের প্রতি বিশ্বাস এই কোভিডকে জয় করতে সাহায্য করবে।

চন্দ্রমা দাস তেয়াগী, ভূপালের বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরের প্রধান পুরোহিত, এপ্রিলের ৬ তারিখ ২৫ জন অনুসারী নিয়ে মেলায় আসেন। ১২ তারিখ রাতে তার জ্বর আসে, পরে কোভিড পজিটিভ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৯ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদের মতো তার অনুসারীরাও সরাসরি যার যার গ্রামে ফিরে যায়। মধ্য ভারতের ছোট শহর জয়ারাশপুরে ৮৩ জন পুণ্যার্থীর ৬০ জনের পজিটিভ আসে যাদের অধিকাংশই টেস্ট করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। সেই শহরের চিকিৎসকের অভিমত কুম্ভ মেলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আমরা এখন অনেক ভালো অবস্থানে থাকতে পারতাম।

অনেক পুণ্যার্থী ট্রেনে করে গুজরাটের আহমেদাবাদে এ ফিরে গেছে। তাদের দশ শতাংশই কোভিড টেস্টে পজিটিভ আসে। উড়িষ্যা ও আসাম কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে হরিদুয়ারা (কুম্ভ মেলার স্থান) থেকে ফিরে আসা অনেকেই কোভিড টেষ্টে পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে।

বহুত পেয়ার করতে, পরদেশি পরদেশি, মেরা দিলভি কিতনা পাগল হায়.. এরকম আরো অনেক হৃদয় কাঁপানো গানের কথা উঠলেই মনে পড়বে বলিউডের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক শ্রাভান রাথোড এর কথা। তিনিও সস্ত্রীক কুম্ভ মেলায় গিয়েছিলেন অতঃপর কোভিড সংক্রমিত হন এবং মারা যান।

কুম্ভ মেলা যে রাজ্যে হয় অর্থাৎ উত্তরাখণ্ডে এপ্রিলের শুরুতে প্রতিদিন শনাক্ত হত ৫০০ কোভিড কেস, ঐ মাসের শেষের দিকে সেটি গিয়ে দাঁড়ায় দৈনিক ৬ হাজারে। ডাক্তার ও প্যারামেডিক্স যারা মেলায় দায়িত্বরত ছিল তাদের প্রতি পাঁচজনের একজন কোভিড পজিটিভ এসেছে।

কুম্ভ মেলা ছাড়াও নির্বাচনী সভা, বিয়ে-শাদির উৎসব, খেলাধুলার ইভেন্ট ভারতে কোভিড ছড়িয়ে পড়ায় অবদান রেখেছে।

তামিলনাড়ুর জনস্বাস্থ্যবিদ জ্যাকব জোয়ের মতে এসব গেদারিং, যাতে লোকজন গাদাগাদি করে থেকেছে, করোনাভাইরাস বিস্তারে মূল ভূমিকা পালন করেছে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নির্দিষ্ট এলাকার লোকজনের সমাগমে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কুম্ভ মেলায় লোকজন এসেছে ভারতের প্রতিটি এলাকা থেকে। ফলে অন্য এলাকার ভেরিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমিত হয়ে পুণ্যার্থীরা তা নিজ এলাকায় বয়ে নিয়ে গেছে।

বিভিন্ন আখড়া যারা সমবেতভাবে মেলায় অংশ নেয় তারাও কোভিড সংক্রমণে ভূমিকা রেখেছে। নির্জনি আখড়ার রবীন্দ্র পুরি জানিয়েছেন তাদের সংগঠনের ৯ জন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন।

তবুও অনেক ধর্মীয় নেতা বলছেন, তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। ৭৩ বছর বয়সী ধর্মদাশ জী, যিনি কুম্ভ মেলায় শত শত পুণ্যার্থী পাঠিয়েছেন, বলেন কোভিড আসবে যাবে কিন্তু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত কোনো ধর্মোৎসব বন্ধ রাখা যায় না।

এসব নিয়ে ল্যানসেট তার সম্পাদকীয়তে ভারত সরকারের সমালোচনা করে বলেছে নিজ সৃষ্ট এই বিপর্যয়ের জন্য সরকার নিজেই দায়ী থাকবে  ("Modi's Government would be responsible for presiding over a self-inflicted national catastrophe"- Lancet )

এদিকে বাংলা ছবির এক খল অভিনেতা বলেছেন, করোনা মানে কোরআন-রোজা-নামাজ। এই তিনটি মেনে চললে করোনা হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাই নাই। জবাবে আরেকজন লিখেছে, আমিতো কোরান পড়ি, রোজা রাখি, নামাজ পড়ি- আমার কেন তবে কোভিড হলো?

মোদ্দা কথা হলো যে ধর্মেরই হোক, তাদের বিশ্বাসের ভাইরাস করোনাভাইরাসের কাছে নিতান্ত তুচ্ছ এবং অসহায়- সেটা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে।

লেখক: চিকিৎসক, এফসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (চেস্ট ডিজিস), বিএসএমএমইউ

ঢাকাটাইমস/১২মে/এসকেএস