খুঁজে ফিরি হারানো ঈদ আনন্দ

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
| আপডেট : ১৩ মে ২০২১, ১৭:৫১ | প্রকাশিত : ১৩ মে ২০২১, ১৭:৪১

ছেলেবেলার ঈদের আনন্দ এখন আর পাই না। হারিয়ে গেছে। কোথায় যে হারালো! অনেক খুঁজেছি। কড়কড়ে নতুন টাকায়। মা-বাবার পায়ে হাত রেখে দোয়া নেওয়ার সেই সালামির ঘ্রাণ পাই না। নতুন জামা, আতর, টুপিতে? নেই। সবই কেমন পুরনো। ঈদ ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে আলমিরায় লুকিয়ে রাখা জামার ভাজের সেই আনন্দ নেই। সেমাই, পায়েস, মাংস, পোলাও-সবই কেমন পানসে। পাড়া ঘুরে বন্ধুদের মায়ের হাতের রান্না খাওয়া; দিন শেষে সবাই মিলে নিজেদের বাসায় পাত পেতে ভুরিভোজের স্বাদ আজ নিখোঁজ।

কতই তো ঘুরে বেড়াই ঈদে। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাই। গল্প হয়, আড্ডা হয়। সেই উল্লাস হয় না। যাকে আনন্দ বলি, আজ তা নেই। আছে, অন্তসারশূন্য লৌকিকতা। কৃত্রিমতায় ঠাসা। একটা সময় বাবা নতুন খেলনা কিনে দিলে, পাট পাট করে খুলে বিস্ময় খুঁজতো চোখ। যন্ত্র খুলে ফেলা গাড়ি কিংবা পুতুলটা পড়ে থাকত মরার মতো। আমরাও দিনকে দিন তেমন প্রাণহীন খেলনা হয়ে যাচ্ছি। আর বিস্ময়ভরা চোখ দুটোও কেমন নির্জীব, নির্লিপ্ত। ‘প্লিজ, একবার অবাক হয়ে দেখো প্রিয় চোখ!’ এই দরখাস্তে সায় নেই কোনো।

মানুষ অবাক হওয়ার ক্ষমতা হারালে জীবনের কী আর বাকি থাকে? যে চোখ পুলকিত হয় না, সেই চোখ মৃত্যুসম। মৃতের চোখ দুটি যেমন অন্তরিক্ষের পানে একধ্যানে চেয়ে থাকে, তেমনই।

ঈদ আসে, ঈদ যায়—সেই কল্লোলের দেখা নেই। প্রতিবারই অপেক্ষায় থাকি, এবার ঈদে আনন্দরা আসবে মনের উঠোনে। রঙিন কত ভাবনা এসে রাঙাবে ধূসর মনটা। হয় না। হয়ে ওঠে না আর।

চাঁদরাত, ঈদের ভোরে গোসল সেরে নতুন জামা পরা, মিষ্টান্ন খেয়ে বাবা কিংবা নানুভাইয়ের হাত ধরে নামাজে যাওয়া, নামাজ শেষে সমবয়সীদের বুকে বুক মিলানো, হাতে হাত রাখা—শৈশবের সেই উচ্ছ্বাস আজ নির্বাসিত। বন্ধুরা? তারাও আজ কে কোথায়। সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেগুলো আজ কর্মব্যস্ত মানুষ। দেখে মনে হওয়ার উপায় নেই যে, তারাও একদিন শিশু ছিল। ছিল বিস্ময়ভরা শৈশব, রঙিন কৈশোর।

এখন চাঁদ দেখার জন্য মাগরিবের নামাজ শেষে মসজিদের ছাদে আর ওঠা হয় না। ঘরে ফিরে জানালা দিয়েও দেখা হয় না আকাশ। চাঁদ দেখা কমিটির কথা যেদিন থেকে জানা হলো, চাঁদ দেখার আনন্দও সেদিন থেকে উধাও। সারাদেশের মানুষের চাঁদ দেখার দায়িত্ব এক কমিটির ঝোলায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওই কমিটি ঈদের চাঁদের আনন্দটা দৈত্যের মতো জাদুর বোতলে ভরে, ছিপি আটকে গহিন সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে।

আকাশে চাঁদ দেখলে মা বলতেন, ‘সালাম দে বাবা। নতুন চাঁদকে সালাম দিতে হয়।’ হাত তুলে সালাম জানাতাম মিষ্টি কুমড়ার ফালির মতো চাঁদকে। মনে হতো শুনতে পেয়ে খুশি হয়েছে চাঁদ। কখনো সখনো মেঘের আড়ালে চাঁদের লুকোচুরি দেখতে দেখতে সময় যে কখন, কীভাবে কেটে যেত!

কী মুগ্ধতামাখা সময় ছিল সেসব! সামান্য কোনো প্রাপ্তিতেই কী যে পুলোকিত হতাম! ঈদ কার্ড, স্টিকার, ভিউকার্ড, প্লাস্টিকের ভেঁপু— বন্ধুদের থেকে পাওয়া অমূল্য সব উপহার। রঙিন কার্ডে হাতে লেখা, ‘ঈদেরদিনে বন্ধু তুমি এসো আমার বাড়ি। তোমায় নিমন্ত্রণ।’

বিনোদনের সহজ ও একমাত্র মাধ্যম ছিল বিটিভি। ঈদের চাঁদ আকাশ ফুঁড়ে উঠতে না উঠতেই বাতাসে ভেসে আসত ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’ বুকের ভেতরে কেমন অস্পর্শী আহ্লাদ দোল দিয়ে যেত। এখনো শুনি, কিন্তু সেই আহ্লাদ নেই।

ছোট্টবেলার মতো ঈদের চাঁদ দেখার পরমানন্দ আর হৃদয় ছুঁতে পারে না। নতুন পোশাকেও উচ্ছ্বসিত হয় না মন। রসনাবিলাসের কত পদ, কিন্তু ভোজনের সেই আগ্রহ নেই। খেতে হয় বলে খাওয়া। হাসতে হয় বলে হাসা। যেতে হয় বলে যাওয়া।

তবুও ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। আসে সম্প্রীতির পয়গাম নিয়ে। যেখানে হয়তো লেখা আছে আমার সেই হারানো ঈদ-আনন্দের দিনলিপি। আদতে পাথুরে চোখের আমি, তার কিছুই দেখি না।

লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :