ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা: ‘সুশীলগণ’ দায় এড়াবেন কীভাবে?

মো. আক্তারুজ্জামান
| আপডেট : ১৪ মে ২০২১, ১২:৫৫ | প্রকাশিত : ১৪ মে ২০২১, ১২:৪৯

সুনানে আবু দাউদের ৫১২১ নং হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে- জুবায়র ইবনু মুত্ব‘ইম (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আসাবিয়্যাতের দিকে ডাকে বা সম্প্রদায়ের দিয়ে আহ্বান করে লোকদেরকে সমবেত করে সে আমার দলভুক্ত নয়। আর ঐ ব্যক্তিও আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসবিয়্যাতের/সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে যুদ্ধ করে এবং সেও নয় যে আসাবিয়্যাতের উপর মারা যায়।

উল্লিখিত হাদিসটি বারবার আলোচনায় চলে আসে প্রাসঙ্গীক ঘটনার কারণে। ইসলাম ধর্ম বিষয়ে যারা চর্চা করেন এবং ইসলাম ধর্মকে যারা পরিপূর্ণরূপে মেনে চলেন তাদের পক্ষে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মানসীকতা লালন করে চলা অসম্ভব। অন্যকথায় যদি কেউ আসাবিয়্যাত বা সম্প্রদায়িক চিন্তাধারা লালন করে চলেন তিনি আর যায় হোক মুহাম্মদী মুসলিম হতে পারেন না।

সাম্প্রতিক সময়ে মা দিবসে বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী মায়ের সাথে একটি ছবি তাঁর ফেইসবুকে পোস্ট করলে কিছু সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া সেই পোস্টকে কেন্দ্র করে আলোচনায় আসে এবং বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের লেখক দেশের কয়েকজন খ্যাতিমান আলেমের সাথে কথা বলেছেন। বেশিরভাগ আলেমগণের জবাব ছিল একই ধরনের, সাথে ছিল প্রশ্নও। সেই জবাব ও প্রশ্নের ব্যবচ্ছেদ আমাদের সুশীল সমাজকে নতুন এক বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

চঞ্চল চৌধুরীর পোস্টকে ঘীরে যে অপ্রীতিকর ঘটনা সেটিকে উল্লেখ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়া এবং এ বিষয়ে দেশের আলেম সমাজের দায় কতটুকু তা জানতে চাইলে যে উত্তর পাওয়া যায় তার সরলীকরণ করলে এভাবে বর্ণনা করা যায়, চঞ্চল চৌধুরী যে সমাজের, সেই সমাজের সাথে আলেম সমাজের স্বাভাবিকভাবেই দূরত্বটা অনেক বেশি। কেউ কেউ জীবনে প্রথমবার চঞ্চল চৌধুরীর নাম শুনেছেন এই ঘটনার প্রেক্ষিতে। সুতরাং এমন একটি ব্যক্তির ছবি বা পোস্ট নিয়ে আলেম সমাজের কেউ বাজে মন্তব্য করবে বা বাজে প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। তাছাড়া একজন তো মূল পোস্টের উপর রিঅ্যাক্ট ও কমেন্টের একটা পরিসংখ্যান উপস্থাপন করলেন। সে হিসেবে ঐ সময় পর্যন্ত আলোচিত পোস্টটিতে ২ লক্ষ ৬৫ হাজার রিঅ্যাক্ট আর ২০ হাজারের মতো কমেন্ট হয়েছে, পাশাপাশি পোস্টটি শেয়ার হয়েছে প্রায় হাজার বার। এই যে রিঅ্যাক্ট, তারমধ্যে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার লাভ, এক লক্ষ ১৫ হাজার লাইক, ৬ হাজার ৪ শত কেয়ার, ৪ শত ১৫ টি ওয়াও, ৬৫ টি আবেগের কান্না আর এর বিপরীতে নেতিবাচক রিঅ্যাক্ট ৩০০ টিরও কম (২৫১ টি হাহা, ৪১ টি বিরক্তির)। কমেন্টগুলোর বিশ্লেষণও তিনি একইভাবেই উপস্থাপন করেন। মোটকথা পোস্টটিতে এক শতাংশেরও অনেক কম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে যেগুলো আপত্তিকর।

অবশ্যই সেটিও মেনে নেয়া যায় না। তারা জোর দিয়ে বললেন যারা এটি করেছেন, নিশ্চিতভাবে বলা যায় তারা আলেম সমাজের অন্তর্ভূক্ত নন, হতে পারেন না। আলোচকদের মধ্যে একজন পিনাকী ভট্টাচার্য নামক জনৈক প্রবাসী ডাক্তারের এই সম্পর্কীত পোস্ট উল্লেখ করে বললেন চঞ্চল চৌধুরীর পোস্টে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেতিবাচক যে প্রতিক্রিয়া এসেছে তা রাজনৈতিক কারণে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তিনি বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি দলের নেত্রীকে নিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন। তাঁর সেই কর্যক্রমের বিরোধীতাকারীরা হয়তো যেকোনভাবে তাঁকে বিরোধীতা করার চেষ্টা করছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি ধর্মীয় প্রতিক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে। আর এই প্রতিক্রিয়া আলেম সমাজ তো সমর্থন করেই না বরং উপর্যুক্ত হাদীসের আলোকে তাদের মুসলমানিত্ব ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করে তাদের তওবা করার পরামর্শ দিয়েছেন।

স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মাঝে একজন আলেমের প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সমাজে যে ব্যক্তিবর্গ আজ এই গর্হিত কাজটির প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন একবারে সামনের কাতারে থেকে তাদের মধ্যে এই ভালো কাজটি করার নৈতিক অধিকার এই মুহূর্তে কতজনের আছে সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এই বক্তব্যের পক্ষে যে যুক্তি তা হচ্ছে, ঠিক আরেকজন মাকে নিয়ে গতবছর (২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে) একটি ছবি ভাইরাল হয়। শেখ ইয়ামিন নামে মাদ্রাসা পড়ুয়া এক শিশুর সাথে তার মা ক্রিকেট খেলেছিলেন। আর ক্রিকেট খেলার সময় সেই মায়ের পরনে ছিল ধর্মীয় পোশাক। এই ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এলে নেটিজেনদের মধ্যে সৃষ্টি হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। চঞ্চল চৌধুরীর পোস্টে যে পরিমান ও মাত্রায় বাজে প্রতিক্রিয়া হয়েছে তার অনেকগুন বেশি হয়েছিল সেই ছবিতে।

প্রশ্ন হচ্ছে আজ যারা সুশীল সমাজের পরিচয়ে আলোচিত জঘন্য ঘটনাটির সমালোচনা করছেন তারা কি ঐ সময় এভাবে ঐ মায়ের প্রতি যে বাজে মন্তব্য হয়েছিল তার প্রতিবাদ করেছিলেন? উক্ত আলেম কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে প্রমাণ করলেন সমান আচরণ তো করেনইনি বরং আজ যারা চঞ্চল চৌধুরীর পোস্টে দুঃখজনক আচরণের প্রতিবাদ করছেন তাদের অনেকেই সেদিন শেখ ইয়ামিনের মায়ের ধর্মীয় পোশাকের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন এবং তা ছিল খুবই অসম্মানজনক ও আপত্তিকর। তাদের সরল প্রশ্ন- আমাদের সুশীলগণ কী আসলেই সুশীল নাকি তারা কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধে (স্পষ্ট করে বলতে গেলে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে) বিদ্বেষ ছড়িয়ে তৃপ্ত হতে চান?

মা, ধর্ম, ধর্মীয় বিধি, মাতৃভূমি আসলে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। যারা এই বিষয়গুলো হৃদয়ে লালন করেন, তারা এগুলোর নূন্যতম অমর্যাদাকে মেনে নিতে পারেন না, মেনে নেয়া উচিৎও নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই রীতি কি সকলের জন্য সমান হওয়া উচিৎ নাকি ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে ভিন্ন হবে। আজ সম্মানিত অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলে সকলেই সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন কিন্তু এই ঘটনাটি যখন আরো শতগুণে নোংরাভাবে শেখ ইয়ামিনের মায়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল তখন কেন একই ব্যক্তি ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন অথবা নিরব ছিলেন?

আমাদের সুশীল সমাজের অধিকাংশ কি একচোখা হয়ে উঠছেন না? আপনার-আমার কাছে চঞ্চল চৌধুরীর মাকে মা মনে হলো, তাঁর ধর্মীয় আচরণকে শ্রদ্ধা করা উচিৎ মনে হলো তবে শেখ ইয়ামিনের মায়ের ক্ষেত্রে কেন ভিন্ন আচরণ করলাম, কেন শেখ ইয়ামিনের ধর্মকে অসম্মান করার বিষয়টিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলাম অথবা নিরবে মেনে নিলাম?

মূলত বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী, ‘প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় মুসলিম’ অধ্যুষিত দেশে সেটার পরিমান আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা ছিল কারণ হিসেবে আলোচনার শুরুতেই উল্লিখিত হাদীসটির কথা উল্লেখ করা যাবে বারবার। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ‘ধর্মীয় গাঁধা’ সম্প্রদায়ের লোক এদেশে রয়েছে এবং তাদের আচরণ সভ্য সমাজের অসাম্প্রদায়িকতাকে ছাপিয়ে বারবার আলোচনায় উঠে আসে। ধর্ম, ধর্মের বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এ সমস্ত ধর্মীয় অশিক্ষিত, অসভ্য লোকজন সভ্য আচরণ করতে শেখেনি। অবশ্য এই ধরনের মানুষগুলোকে যেমন প্রকৃত ইমানদারগণ ঘৃণা করেন তেমনি ঘৃণা করেন সমাজের সর্বস্তরের জনগণ।

দুঃখজনকভাবে প্রাসঙ্গিক আলোচনার সূত্র ধরে সার্বিক বিবেচনায় আমাদের সুশীল সমাজকে নিয়ে কথা বলারও সুযোগ ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। ধর্মের মতো এত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে দ্বিচারিতার অভিযোগে যারা অভিযুক্ত তারা কতটা সুশীল সমাজে থাকার যোগ্যতাকে সংরক্ষণ করেন? আবার বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়া এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং ঘৃণাকে বিস্তারকারী হিসেবে কুখ্যাত, অজ্ঞ, ধর্মহীন ব্যক্তিগুলোর সাথে তাদেরকেও একই বিচারের কাঠগড়ায় তোলা সময়েরই দাবী বলে উল্লেখ করছেন বিশিষ্ট জনেরা।

লেখক:

বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার ও

পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :