কুড়িগ্রামে দেশের বৃহৎ স্পিরুলিনার খামার

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৪ মে ২০২১, ১৭:৪৫

কৃষি নির্ভরশীল কুড়িগ্রাম জেলায় প্রথমবারের দেশের বৃহৎ কৃত্রিম জলাধারে ‘সবুজ হিরা’ খ্যাত স্পিরুলিনা চাষ হচ্ছে। এতে আত্মনির্ভরশীল হবার পাশাপাশি দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা। সরকারি সহায়তায় কেমিক্যাল সহজলভ্য হলে এই স্পিরুলিনা বিদেশি রপ্তানি করা সম্ভব বলে দাবি উদ্যোক্তাদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের কিসামত প্রাণ কৃষ্ণ গ্রামে দেশের বৃহৎ কৃত্রিম জলাধারে সামুদ্রিক শৈবাল খামারের চাষ করে এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছেন সাতজন তরুণ উদ্যোক্তা। বর্তমানে ২৪ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জলাধার তৈরি করেন তারা। এখানেই বাণিজ্যিকভাবে চলছে স্পিরুলিনার চাষ। প্রায় তিন মাস আগে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্পিরুলিনার চাষ শুরু করেন। সবুজ শৈবাল চাষ করে কোটিপতি হবার পাশাপাশি দেশের পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই তাদের এই স্পিরুলিনা চাষ শুরু করেন। খোলা জায়গায় স্পিরুলিনা চাষের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা এই কৃত্রিম জলাধারের চারিদিকে নেট জাল আর পলিথিন দিয়ে নিখুঁতভাবে ঘিরতে হয়েছে। বিশাল এই জলাধার তৈরি করতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এই খামারে ১২ হাজার করে ২৪ হাজার লিটার পানি ধারণ করার জন্য দৈর্ঘ্য ৩১ ফুট ও প্রস্থ ৭ ফুট মাপের দুটি হাউজ রয়েছে। সূর্যের আলো ঢোকার মতো স্বচ্ছ প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি করা হয়েছে ঘর। বীজ হিসেবে ১১ কেজি মা শৈবাল/মাদার কালচার পানিতে দেয়া হয়। রোদ বেশি থাকলে উৎপাদন বেশি হয়। কৃত্রিম উপায়ে ২৪ হাজার লিটার পানিতে এই শৈবাল বেড়ে উঠছে। সমুদ্রের পানির উপাদানের জন্য জলাধারে সাত প্রকার ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। এই ওষুধেই ছয়মাস চলবে। এরপর পানির মাত্রা কমে গেলে তা বাড়াতে আবারও প্রয়োজন অনুপাতে একই উপাদান দিতে হবে। ছাঁকুনি দিয়ে শৈবাল সংগ্রহ করা হয়। কাঁচা শৈবাল শুকালে ওজন হয়ে যায় আগের তিন ভাগের এক ভাগ। বর্তমানে এই জলাধার থেকে সপ্তাহে প্রায় ২০ কেজি করে শৈবাল উৎপাদিত হচ্ছে। সঠিকভাবে বাজারজাত করা গেলে মাসে এই খামারে ২০/৩০ হাজার টাকা খরচ করে ২/৩ লাখ টাকা আয় সম্ভব। বর্তমানে স্পিরুলিনার কেজি প্রতি ৬/৭ হাজার টাকা। এই শৈবালের মধ্যে ক্ষতিকর বস্তুতে কোন কিছু নেই। বরং পুষ্টিমান ডিম, দুধ, মাংস, মাছ ও শাকসবজির চেয়েও বেশি। সুপার ফুড খ্যাত স্পিরুলিনায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহসহ একাধিক খণিজ পদার্থ। যা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে মূল্যবান ভেষজ হিসেবে দেশে-বিদেশে স্পিরুলিনার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। স্বাদ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন স্পিরুলিনা নিয়মিত সেবন করলে দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতা, রাতকানা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, বাত, হেপাটাইটিসসহ হাজারো রোগ নিরাময়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখে স্পিরুলিনা। এরমধ্যে প্রোটিন ৬০-৭০%। যার বেশিরভাগই ইসেনশিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে গঠিত। কার্বোহাইড্রেট ১৫% হিসেবে থাকে গ্লাইকোজেন, ফ্যাট ৫-৮% মূলত ইসেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিড যেমন, গামা লিনোলেয়িক অ্যাসিড বেশি থাকে। এছাড়াও মিনারেলসের মধ্যে রয়েছে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও সেলেনিয়াম। ভিটামিনের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৬, বি-১২, ভিটমিন-ই এবং ভিটমিন-কে। আর ন্যাচারাল পিগমেন্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ক্লোরোফিল, জ্যান্থোফিল, বিটা ক্যারোটিন ও ফাইটোসায়ানিন। এতে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকায় একে ‘সুপার ফুড’বলা হয়। অপ্রয়োজনীয় স্পিরুলিনা মাছের খাদ্যও হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

উদ্যোক্তা গোলাম মন্ডল জানান, স্পিরুলিনা চাষের উপর শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে একদিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। গত মার্চ মাসে ৭ জন উদ্যোক্তাসহ প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয় করে স্পিরুলিনার চাষ শুরু করে। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ কেজি করে স্পিরুলিনার উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি কেজি স্পিরুলিনার দাম ৫/৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। লকডাউন আর করোনার প্রভাবের কারণে এখনো বাজারজাত করতে পারেনি। তবে ৫/৭টি ওষুধ কোম্পানির সাথে আলোচনা চলছে।

উদ্যোক্তা জাকির হোসেন বলেন, দারিদ্রপীড়িত এই দেশে জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটানো এবং নিজেদের আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে স্পিরুলিনা চাষের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও আমরা ফুলবাড়ি এ্যাগ্রো কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি খুলেছি। এখানে মাছ, সবজিসহ খামার তৈরি করা হয়েছে।

উদ্যোক্তা সেলিম রেজা বলেন, স্পিরুলিনা বাজারজাত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয়। স্পিরুলিনার পুষ্টি গুণাগুণ সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণার অত্যন্ত জরুরি। সরকারি-বেসরকারিভাবে এটি বাজারজাত করা গেলে সাধারণ মানুষের কাছে স্পিরুলিনার চাহিদা বাড়বে। তবে স্পিরুলিনা চাষে বড় বেগ পেতে হয় এর কেমিক্যাল পাওয়া। স্পিরুলিনার চাষে কয়েকটি মূল্যবান কেমিক্যাল রয়েছে যেগুলো খুচরা পাওয়া যায় না। সেগুলো সহজলভ্য করা গেলে দেশের অনেক বেকার তরুণ স্পিরুলিনা চাষ করে স্বাবলম্বী হতে পারবে। এতে করে দেশের পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

নারী শ্রমিক রশিদা বেগম বলেন, এখানে কাজ করতে হয় মেশিন চালু ও বন্ধ করা। এছাড়াও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা কাজ করি। কম শ্রমে মাসে আমার ৪/৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। এই দিয়ে আমার সংসারে বাড়তি আয়ের পথ হয়েছে। অনেক জায়গা থেকে মানুষজন এই প্রজেক্ট দেখার জন্য আসে এখানে।

এই বিষয়ে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মীর্জা নাসির উদ্দিন বলেন, কৃষি নির্ভরশীল এই জেলা প্রথমবারের মতো স্পিরুলিনার চাষ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। স্পিরুলিনা খাদ্য, পুষ্টি গুণাগুণের বিবেচনায় এটিকে গ্রিন ডায়মন্ড বলা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিভিন্ন সদস্য দেশে পুষ্টিহীনতা দূর করতে স্পিরুলিনা ব্যবহারে নির্দেশনা দিয়েছে। স্পিরুলিনার চাষ এভাবে বৃদ্ধি পেলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করেও বিদেশে রপ্তানি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। আমি মনে করি, আমাদের অর্থনীতিতে বিশাল সম্ভাবনাময় খাত।

ফুলবাড়ি উপজেলা কৃষি অফিসার মাহাবুবুর রশীদ বলেন, উপজেলায় সাতজন মিলে স্পিরুলিনা চাষ কার্যক্রম শুরু করেছে। এটি এখন বাজারজাত করণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে। স্পিরুলিনার সুফল সাধারণ মানুষ যদি পায়, তাহলে এটি বাজারজাত করণসহজ হবে। এছাড়াও সরকারিভাবে এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগ আছে তারা যদি বাজারজাতকরণে সহযোগিতা করে তাহলে এমন অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হবে। পাশাপাশি এটিকে আমরা সুপার ফুড হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করতে পারব।

(ঢাকাটাইমস/১৪মে/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :