বরেণ্য উপাচার্য কোথায় পাবো?

প্রকাশ | ১৮ মে ২০২১, ১২:৩৯ | আপডেট: ১৮ মে ২০২১, ১৭:০৮

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ

বিগত কয়েক দশক বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরেণ্য উপাচার্য খুঁজছে।  কিন্তু কোথায় গেলে আমরা বরেণ্য উপাচার্য পাবো? পত্রিকার লেখা থেকে জানতে পারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বরেণ্য শিক্ষকদেরকে নিজেই কাছে ডেকে নিতেন এবং উপাচার্য নিয়োগ দিতেন।  কিন্তু সেই ধারা আজ আর নেই।  কারণ এখন হলো তদবির সংস্কৃতির যুগ।  কে কত সরকারের মন্ত্রী বা এমপির কাছের লোক তিনি ততটা এগিয়ে থাকেন উপাচার্য হওয়ার প্রতিযোগিতায়।  বরেণ্য শিক্ষকদেরকে নিয়ে প্যানেল হয় কিন্তু দেখা যায় তিনি সর্বোচ ভোট পেয়েও উপাচার্য হতে পারেননি।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন, ডিন নির্বাচন, সিনেট নির্বাচন, এবং উপাচার্য প্যানেল গঠন, শিক্ষক নিয়োগ  প্রক্রিয়া থাকলেও সেটা কোথাও কোথাও কার্যকরী নয়।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে  তুলনামূলক ভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলেও ১৯৮৯-থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত  ডাকসু নির্বাচন হয়নি। আমরা লক্ষ্য করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিনা নির্বাচনে এক মেয়াদ পূরণ করেছেন।আরেকবার তিনি অপূর্ণাঙ্গ সিনেটে নির্বাচিত হয়ে তৃতীয়বার উপাচার্য হতে ব্যর্থ হয়েছেন।  বিষয়টি আদালতে গিয়ে নিস্পন্নহয়েছে।বরেণ্য উপাচার্যও তিনি হতে পারতেন।কিন্তু ক্ষমতার বাসনার খাদ থেকে আর তিনি উঠতে পারেনি। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায় উপাচার্য অধ্যাপক আবদুসসোবহানএবছরের আলোচিত উপাচার্যদের একজন।তিনি ১৪১ জনকে এডহক দিয়েছেন। নিয়োগ বিধি পরিবর্তন করে নিজের আত্মীয়দেরকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি ১/১১র সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে জাতির কাছে বরেণ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।সেইসম্মানটুকু তিনি ধরে রাখতে পারেননি। আসলে যারা একবার উপাচার্য হয়েছেন সেই সব সম্মানিত শিক্ষকরা সুনামের সঙ্গে যেতে পেরেছেন।  আর সেই কারণে অনেকেই মনে করেন একজন শিক্ষক যেন একবার উপাচার্য থাকেন। প্ৰশ্ন হলো ভালো কাজ করলে তিনি একবার কেন বারবার উপাচার্য হবেননা কেন ? কিন্তু ভালো এখন একটি আপেক্ষিক বিষয়।  একসময় গণতন্ত্র ভালোছিলো -এখন Benevolent Dictator  আমরা চাই।  সুতরাং, বরেণ্য উপাচার্য ধারণাটিও আপেক্ষিক হয়ে গেছে।  আমরা শিক্ষকরা আমাদের সুবিধা -অসুবিধাকে বেশ মূল্য দিয়ে চলি।  সুতরাং, আমার স্বার্থ ক্ষুন্ন হলে তুলকালাম ঘটিয়ে ফেলতে দ্বিধা করি না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে আছে রাজনীতি।  সেই রাজনীতি যদি জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে মিশে যায় তাহলে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে যায়। শিক্ষক নিয়োগে রাজনীতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা উপলব্ধি করবার ক্ষমতা আমাদের থাকলেও নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়টি যেন গা সহা হয়ে গেছে।  উপাচার্য- বিভাগের সভাপতিরা বলেন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টকে নেবেন।  আর তখনি শুরু হয়ে যায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট বানানোর প্রতিযোগিতা।এবং তখন কে আমার আপনজন, কে আমার এলাকার ছাত্র, কে আমার কোর্স নিলো, কে কোন ভাষায় লিখলো বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। এভাবে সুনীতির পথ থেকে শিক্ষকরা দূরে সরতে থাকেন।  এবং সরতেসরতে এমন একটি অবস্থানে আমরা চলে এসেছি যেকোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা তা বুঝতে পারা কঠিন। 

আজ প্রচারণার যুগ। সুতরাং, উপাচার্য হতে সাংবাদিকদেরকে আমরা উপহার দিতে শুরুকরি।  ডেকে ডেকে সহকর্মীদের সম্পর্কে সত্য মিথ্যা বলি।  নিজের গুণকীর্তন প্রচার করবার ব্যবস্থা এভাবে হয়ে যায়।  জাতীয় -স্থানীয় নির্বাচনে যোগ দেই প্রার্থীরপ্ররোচনায়।এভাবে আমার দিনে দিনে সরে গেছি শিক্ষকের পবিত্র স্থান থেকে। 

আমি নিজেকে প্ৰশ্ন করি আমি কি ঠিক জায়গায়টিতে আছি? দেখতে পাই কখনো কখনো আমি সরে যাচ্ছি আদর্শর জায়গা থেকে।  নিজের ভুল ঢাকতে নানা যুক্তি উপস্থাপন করি।সেভাবে দেখলে হয়তো বর্তমানে আলোচিত উপাচার্যরা যতটুকু ভুল করেছেন তার ক্ষমা নিজের কাছে পেয়ে যাবেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পদে নিয়োগের জন্য নাকি মন্ত্রী, সচিব , এমপি , স্পিকার পর্যন্ত সুপারিশ করেন।  সুপারিশ করা অন্যায় বলা যায় না।  কিন্তু যদি বল প্রয়োগ করেন তাহলে উপাচার্য কি করতে পারেন? শুনেছি উপাচার্যদেরকে তালিকা দেয়া হয় এবং না করলে করুন পরিনিতির হুমকি দেয়া হয়।  পদত্যাগ করে সরে যাবেন তাতেও রক্ষা পাবেন না।  ওই অপশক্তি আপনার পিছু ছাড়ে না।  সুতরাং, যারা আমাদের বরেণ্য শিক্ষক তারা ভুলেও উপাচার্য হওয়ার বাসনায় সরকারি মহলে যোগাযোগ করেন না।  আর বঙ্গবন্ধু আজ নেই সুতরাং , কেউ বরেণ্য শিক্ষকদেরকে উপাচার্য হিসেবে দেখতে যোগাযোগ করেন না।উপাচার্য এখন একটি কেরানিরপদ।হুকুম আসবে আর আদেশ পালন করবেন।

সেই হুকুম নিজের পরিবার , বিভাগ , দল , এমপি প্রমুখ জায়গায় থেকে আসে।বেচারা উপাচার্য দিন দিন দুর্নীতির সুরা পান করতে করতে একদিন ঢলে পড়েন। 

তবুও আমরাআশা ছাড়িনা।  একদিন আমরা আবার বরেণ্য উপাচার্য পাবো।  সত্যের কাছে মিথ্যা পরাজিত হবে।  আমরাযারা ধসের পথে নেমেছি- সেখান থেকে যেন ফিরে আসি।  শিক্ষক সমাজের ধস বৃহত্তর সমাজের প্রতিফলন। শিক্ষকদেরকে কারা আজ এঅবস্থানে নিয়ে গেছে কিংবা নিজেরা কতটুকু সেজন্য দায়ী তা পর্যালোচনা সময় এখন।  আমরা নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে হয়তো চলে যাচ্ছি।  সততাকে যেন আমরা আবার আমাদের জীবন চলার আলো মনে করি।  আমরা জানি আমরা কে কোথায় ভুল করছি।  যেসব উপাচার্য ভুল করেছেন তারা সেটা স্বীকার করে জাতির কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবেন।  আমাদের দেশে উপাচার্য জবাবদিহি  করবেন আচার্যের কাছে।  সেজন্য নিয়মিত মহামান্য আচার্য উপাচার্যদের সঙ্গে কথা বলেন।  মহামান্য আচার্য প্রায় বলেন-তেমন কোনো কাজ নেই। আমার মনে হয় আজ মহামান্য আচার্যের দেখভাল করবার সময় এসেছে।  শিক্ষকরা সংক্ষুব্দ।  কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমলা নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।  আমরাজানি আমলাদেরকে খুশি করতে আমাদের শিক্ষকরা সমানে পিএইচডি উপহার দিচ্ছেন।সেইসংকট থেকে উত্তরণের জন্য মহামান্য দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। যাদের নিয়ে আজ সমাজ আলোচনা করছে তাদের নিয়োগ মহামান্য দিয়েছেন। সুতরাং, তাদের কাছে মহামান্য জবাব চাইতে পারেন। জাতিকে সঠিক পথে নিতে মহামান্য আচার্যের ভূমিকা যেন বাঙালির জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকে সেই কামনা করি।

আজ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য , প্রো উপাচার্য , ট্রেজারার পদ শুন্য।  সেগুলো পূরণে অধিকতর সতর্কতা একান্ত কাম্য।  জাতি একজন সৎ উপাচার্য চায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে যাবেন আন্তর্জাতিক মানে।এখন দাবি শুনতে পাই- নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে।শুনতে পাই নিজ জেলা, বিভাগ থেকে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে।  দেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সঠিক ব্যক্তিকে উপাচার্য  নিয়োগ  দেয়ার বিকল্প হতে পারে না।

আমরাজানি, অধ্যাপক আবু সাঈদ চৌধুরী বিচারক ছিলেন।কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতির কাছে তিনি একজন বরেণ্য উপাচার্য। আমরা বরেণ্য উপাচার্য চাই।সেজন্য আমরা আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে ত্যাগ করি।  আমরা প্রাইভেট টিউটর নিয়োগে বুয়েট কিংবা মেডিকেল স্টুডেন্টখুঁজি।তাহলে উপাচার্য -শিক্ষক নিয়োগে কেন মেধা -সততাকে মূল্য দেব না?   রাজনৈতিক/ ব্যক্তিগত/ দলগত  পরিচয় যেন আমাদের বিভ্রান্ত না করে।মেধা ও সততাকে বাদ দিয়ে যে উপাচার্য শিক্ষক নিয়োগ দেবেন তিনি জাতির কাছে অভিশপ্ত হবেন।  জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পালিয়ে বেড়াতে কারো ভালো লাগবার কথা নয়।  নিজেদের ভুলগুলো স্বীকার করতে আপনাদের কোনো বাধা আছে কি?

লেখক:শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়