সেই লতিফ সিদ্দিকী এখন...

প্রকাশ | ২৩ মে ২০২১, ১০:১২ | আপডেট: ২৩ মে ২০২১, ২০:২৩

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস

দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজনীতিক ও মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ছিলেন আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যও। সুঠাম, দীর্ঘকায় দেহের আবদুল লতিফ সিদ্দিকী একসময় সরব ছিলেন আরও নানা বিষয়ে। কিন্তু ২০১৪ সালে আচমকা ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে জড়িয়ে যান ভয়াবহ বিতর্কে। প্রধানমন্ত্রীপুত্রকে নিয়েও কটাক্ষ করেন। টিভি টকশোর আলোচকদের ‘টকমারানি’ বলে বিদ্রূপ করে পড়েন মহা সমালোচনায়। ওই ঘটনার পর মুহূর্তেই টলে যায় তার মন্ত্রিত্বের চেয়ার। হারান সংসদ সদস্যপদ। ছিটকে পড়েন দল থেকেও। বিনা মেঘ নয়, বরং ঘনীভূত মেঘের প্রচণ্ড এক বজ্রপাতে ফিকে হয়ে আসে শশব্যস্ত মন্ত্রীর রঙিন চারপাশ। এখন একেবারেই নিভৃতবাসে তিনি। দৃশ্যের আড়ালে। বাড়ির বাইরে যান না কোথাও। বই পড়েন, লেখেন- এভাবেই সময় কাটে তার।

শনিবার কথা হয় সাবেক এই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। তারা জানালেন, করোনা মহামারির কারণে বাড়ি থেকে বের হন না আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। কারো সঙ্গে খুব একটা দেখাও করেন না। স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী, মেয়ে রাইনা ফারজিন আছেন তার সঙ্গে। তবে ছেলে অনিক সিদ্দিকীর সঙ্গে চলছে সম্পর্কের টানাপোড়েন। অনিক তার পরিবার নিয়ে অন্যত্র থাকছেন। 

লতিফ সিদ্দিকীর কাঁধে এখন ঋণখেলাপির খড়্গ। আছে দুদকের মামলাও। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে করা একাধিক মামলারও আসামি তিনি। এসব মামলা-মোকদ্দমা লড়তে গিয়ে প্রান্ত-বয়সে এসে কার্যত হাঁপিয়ে উঠেছেন একসময়ের দাপুটে এই মন্ত্রী। 

তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, বইপত্র সংগ্রহের দারুণ নেশা ছিল আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর। নান্দনিক নামের একটি প্রকাশনা সংস্থাও ছিল তার। বন্ধ হয়ে গেছে সেটি। গত কয়েক বছরে নামমাত্র দামে বিকিয়ে দিয়েছেন নিজের সংগ্রহে থাকা বিপুলসংখ্যক বই।   

লতিফ সিদ্দিকীর একসময়ের রাজনৈতিক সহচররা জানান, রাজনীতি থেকে নিজেকে একরকম সরিয়ে নিয়েছেন তিনি। নিজ এলাকা টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে যান না বহুদিন। তবে কালিহাতীতে তার প্রতিষ্ঠিত কারখানা চলছে। কালিহাতীর নিজের পৈতৃক ভিটায় কোনো স্থাপনা নেই। পুরনো বাড়িটির জরাজীর্ণ অবস্থা। ছেলের করা আবাসন (জমির) প্রকল্পগুলো পতিত পড়ে আছে। কেউ যান না সেসবের খোঁজ নিতে। 

কালিহাতী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান একসময় আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর স্নেহভাজন ছিলেন। সাবেক মন্ত্রীর বর্তমান হাল সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘তার (লতিফ সিদ্দিকী) সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। কোথায় আছেন আমি জানি না। একসময় তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ঘটনার পর থেকে আমি আর তার কাছে যাই না। তিনিও আমাকে ডাকেন না।’ 

উপজেলা আওয়ামী লীগের এই সিনিয়র সহ-সভাপতি বলেন, ‘সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি (লতিফ সিদ্দিকী) যখন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীক নিয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন আওয়ামী লীগ-অন্তঃপ্রাণ নেতাকর্মীরা তাকে বর্জন করে চলে এসেছে। তারপর থেকে তিনি এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও গুরুত্ব হারান।’ 

এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন লতিফ সিদ্দিকী। পরে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে নির্বাচনের পর তিনি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

রাজধানীর গুলশান-১-এর ২৩/এ রোডের ৮ নম্বর বাড়িটি আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর। ছয় কাঠা জমির ওপর সাততলা বাড়িটির পুরোটাতেই তিনি সপরিবারে থাকতেন। তবে এখন তিনি সেখানে থাকেন না বলে জানা গেছে। বাড়িটি এবি ব্যাংক থেকে নেওয়া একটি ঋণের বিপরীতে জমানত রাখা হয়েছিল। তা নিয়ে এখন মামলা চলছে। 

কালিহাতী উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনিরের সঙ্গে ঢাকাটাইমসের কথা হয় শনিবার। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কেমন আছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যত টুকু জানি তিনি ভালো আছেন। বাসাতেই থাকেন। করোনার কারণে খুব একটা বের হন না। বইপত্র নিয়ে থাকেন।’

২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি অনুষ্ঠানে ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হজ, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাবলিগ জামাতকে নিয়ে কটূক্তি করে মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠে তখনকার বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর  বিরুদ্ধে। 

এ ছাড়া ওই বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার আইটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কেও আক্রমণ করে কথা বলেন তিনি। পরে ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের গ(২) ধারা অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

একই দিন রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।

নিজ এলাকার সঙ্গে লতিফ সিদ্দিকীর যোগাযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কালিহাতী পৌরসভার প্যানেল মেয়র সিদ্দিক হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সাবেক এমপি সাহেব এখন আর এলাকায় আসেন না। তার পরিবারের কাউকেও আসতে দেখি না। কীভাবে আছেন, কেমন আছেন বলতে পারব না।’  

২০১৪ সালের ২৪ অক্টোবর আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করে, তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকেও চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়। পরে বিভিন্ন অভিযোগে দেশের বিভিন্ন আদালতে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। বগুড়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের করা একটি মামলাতেও আসামি তিনি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালত থেকে জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। পরে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন মামলায় জামিনে আছেন। 

সর্বশেষ গত ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন লতিফ সিদ্দিকী। তার ট্রাক প্রতীকের নির্বাচনী জনসংযোগে ১৬ ডিসেম্বর কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়া বাড়ি এলাকায় গেলে লতিফ সিদ্দিকীর গাড়িবহরে হামলা করে চারটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ওই দিন দুপুর থেকে তিনি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। অনশনের চতুর্থ দিনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়। এরপর আর এলাকায় যাননি তিনি। 

১৪২ কোটি টাকা ঋণখেলাপির অভিযোগ তার কাঁধে

আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রী হওয়ার পর ম্যাজেস্টিকা হোল্ডিং লিমিটেড নামে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তার পরিবারের সদস্যরা। হঠাৎই ব্যবসায়ী বনে যান স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী, ছেলে অনিক সিদ্দিকী ও মেয়ে রাইনা ফারজিন। গড়ে তোলা হয় ধলেশ্বরী লিমিটেড নামে পৃথক একটি কোম্পানিও। এ দুই কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় শতকোটি টাকার ঋণ। ওই ঋণ আর পরিশোধ করা হয়নি। 

খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য লতিফ সিদ্দিকীর পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক লিমিটেড। মামলাগুলোয় আসামি করা হয় আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে। পরিবারটির কাছে ব্যাংক তিনটির সব মিলিয়ে পাওনার পরিমাণ ১৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল আদালত।

(ঢাকাটাইমস/২৩মে/মোআ)