টিকটক-প্রেম-আড্ডা সবই চলে গোরস্থানে (পর্ব-১)

প্রকাশ | ০২ জুন ২০২১, ০৯:৪৭ | আপডেট: ০২ জুন ২০২১, ১২:১৮

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

দেশের সবচেয়ে বড় কবরস্থান রাজধানীর রায়েরবাজারে। ৮১ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা কবরস্থানটিতে প্রায় এক লাখ মানুষের দাফনের ব্যবস্থা রয়েছে। পুরো কবরস্থানটিকে ১৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর আগে গড়ে তোলা কবরস্থানের অনেক ব্লকেই এখনো দাফন কাজ শুরু হয়নি। 

কবরস্থান মৃত মানুষকে দাফন করার জায়গা হলেও এখন এ জায়গাটি অনেকটা বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। একদিকে প্রিয় মানুষের কবরের পাশে অশ্রু সিক্ত নয়নে দোয়া করছেন স্বজনরা, পাশেই যুগলবন্দি হয়ে আনন্দে মেতে উঠছেন আরেক দল কপোত-কপোতী। 

শুক্রবারসহ যেকোনো ছুটির দিনে গোরস্থানটিতে থাকে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরসহ সব বয়সীর অবাধ বিচরণ জায়গাটিতে। কেউ কেউ গোরস্থানে ঘুরতে আসছেন সপরিবারে।

কবরের পাশ দিয়ে হাত ধরে ঘোরাফেরা, কবরের সঙ্গে দাঁড়িয়ে-বসে ছবি তোলা, হাসি-ঠাট্টা, প্রেম, দৃষ্টিকটু চলাফেরা এখন গোরস্থানটির নিয়মিত চিত্র। 

গোরস্থানের সমতল হাঁটার রাস্তায় কেউ কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন বেপরোয়া গতিতে। কিশোররা গোরস্থানে আসছেন টিকটক বানাতে। 

গোরস্থানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের অনেকেই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে নারাজ। গোরস্থানে আসা এক যুগলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে একজন বলেন, ‘অসম্ভব ভাই। কিসের কথা বলব? কোনো কথা বলতে পারব না।’ 

তবে অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। গোরস্থানে ঘুরতে আসার কারণ জানতে চাইলে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন তাদের অনেকেই।

সপরিবারে গোরস্থানে আসা একটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এক নারী জানান, তাদের অনেক আত্মীয়কে এই গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তাদের কবর জিয়ারতে এসেছেন তারা। 

কবরটি কোন ব্লকে বা কত নম্বর কবর জানতে চাইলে এর উত্তর দিতে পারেননি ওই নারী। 

তবে তার সঙ্গে থাকা ওই নারীর স্বামী বলেন, ‘আমরা আসলে ঘুরতে এসেছি।’

এদিকে রায়েরবাজার গোরস্থানে ঘুরে বেড়ানো অন্যদের সঙ্গে কথা বললে তাদের ভাষ্য, তারা ঘুরতে এসেছেন।

গোরস্থান ঘোরাফেরার জায়গা কি না এমন প্রশ্নের জবাবে কেউ কেউ নেতিবাচক জবাব দিয়েছেন, কেউবা চুপ ছিলেন। 

এদিকে গোরস্থানের একাংশে টিকটক বানাতে দেখা গেছে স্থানীয় কিশোরদের। গোরস্থানের ভেতরে অপসংস্কৃতি চর্চার যৌক্তিক ব্যাখা নেই তাদের কাছে।

ঢাকাটাইমসকে তারা জানান, তাদের বাসা আশপাশেই। সময় পেলে গোরস্থানে আসেন এবং টিকটক ভিডিও বানান।

গোরস্থানের এমন চিত্র মনঃক্ষুণ্ণ এবং বিরক্ত করছে স্বজনদের কবর জিয়ারতে আসা মানুষদের। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। 

মায়ের কবর জিয়ারত শেষে আজিজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এখানে যা চলছে তা কখনো একটি গোরস্থানের চিত্র হতে পারে না। আমরা স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর। অথচ পাশে বসে তারা হাসাহাসি করছে। এটা আমাদের জন্য কষ্টের।’

আব্দুস সালাম নামের অপর একজন বলেন, ‘গোরস্থান প্রেম করা বা টিকটক ভিডিও বানানোর জায়গা হতে পারে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক হতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে আমি এই চিত্রই দেখছি। সত্যি এটা খুবই কষ্টদায়ক।’

গোরস্থানের মানুষের অবাধ প্রবেশ এবং দৃষ্টিকটু চলাচলের বিষয়ে অবগত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও। উত্তর সিটির আওতাভুক্ত কবরস্থানের বেশিরভাগটাই করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের অধিভুক্ত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ ঢাকা টাইমসকে জানান, বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজেও এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তবে বেশ কিছু জটিলতার কারণে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি।

আসিফ আহমেদ বলেন, ‘কবরস্থান মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র জায়গা। কিন্তু শুক্র, শনিবারে এখানে অনেক কাপল দেখা যায়। আমি নিজেও চেষ্টা করেছি। কিন্তু একদিক থেকে আটকালে অন্য দিক দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। 

সমস্যা সমাধানে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন আশ্বাস দিয়েছেন উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘এটা তো হতেই পারে না। এটা তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একাধারে কয়েকদিন অভিযান পরিচালনা করলে, জেল জরিমানা করলে...আইনের প্রয়োগ যদি সঠিকভাবে করা যায়, তাহলে এটা আর থাকবে না।’

এ বিষয়ে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হবে বলেও জানান উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। 

তবে করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে জানিয়েছেন, কবরস্থানে কোনো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পরিকল্পনা তাদের নেই। 

(ঢাকাটাইমস/২জুন/কারই/কেআর)