জীবন জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে আগামীর প্রত্যাশা

প্রকাশ | ০৩ জুন ২০২১, ০৮:২২ | আপডেট: ০৩ জুন ২০২১, ০৯:০৪

রহমান আজিজ, ঢাকাটাইমস

মহামারী করোনাভাইরাসে ইতিহাসের বড় দুঃসময় পার করছে মানবজাতি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতিই বিপর্যস্ত। দেশেও অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। জীবন রক্ষার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার সঙ্গে যুগপৎ চলছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লড়াই।

ইতিহাসের নজিরবিহীন এমন সংকট মোকাবিলায় অর্থমন্ত্রী জাতিকে আজ কী সুখবর দেবেন তা জানতে সংসদের দিকে থাকবে সবার চোখ। আজ বিকাল তিনটায় আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি। এই বাজেটে প্রাধিকার পাবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এবারের বাজেটটি প্রস্তুত হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভুত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়ে।

সঙ্গত কারনেই এবারের বাজেটে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত প্রনোদণা প্রাকেজসমূহের বাস্তবায়ন, কৃষি খাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অর্থবছরের পুরো সময়জুড়েই থাকবে সরকারের নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, বাড়ানো হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।

এবারের বাজেটে মোট আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। যা সর্বকালের রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি। ঘাটতি মেটাতে সরকার বৈদেশিক ব্যবস্থাপনা থেকে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

এছাড়া ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে। এ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমকি ৩ শতাংশ।

জানা গেছে, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য সর্বকালের রেকর্ড ঘাটতি বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঘাটতি দাঁড়াবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ৬ শতাংশ। যদিও গত দশ বছর ধরে বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই ছিল।

বাজেটের আকার: আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার বা ব্যয় ধরা হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বেড়েছে।

বাজেট আয়

আগামী বাজেটে ব্যয়ের বিপরীতে মোট আয় ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আয় বাড়ছে ১১ হাজার কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও এনবিআরকে একই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া রয়েছে। প্রথমবারের মতো এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা এক টাকাও বাড়ানো হচ্ছে না।

এ ছাড়া আগামী বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হচ্ছে তিন হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

বাজেট ব্যয়

আগামী বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর আবর্তক ব্যয় ধরা হচ্ছে তিন লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ছয় হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে ব্যয় সংকোচন নীতির অংশ হিসেবে সরকারি চাকরিজীবীদের গাড়ি কেনা নিষিদ্ধ করা, বিদেশ ভ্রমণে বরাদ্দ অর্ধেক কমানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে এ খাতে ব্যয় কিছুটা কমেছে।

ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে আগামী অর্থবছর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ ও পূর্ত কাজ, শেয়ার ও ইক্যুইটি খাতে বিনিয়োগ চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমাবে সরকার। মূলধন ব্যয় নামে এসব খাতে আগামী অর্থবছর বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ দশমিক ৬৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেটে এটি ছিল ৩৬ দশমিক ৪৯০ কোটি টাকা। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এসব খাতে ব্যয় কমিয়ে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ২১,১৪১ কোটিতে নামানো হয়েছে।

বাজেট ঘাটতি

আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ঘাটতি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আলোচ্য অর্থবছরে ঘাটতি ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি কমিয়ে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা আর রাজস্ব আদায়ে ধীর গতি, অন্যদিকে অপ্রত্যাশিত ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজেট ঘাটতি বাড়ছে।

ঘাটতি অর্থায়ন

ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক অর্থায়ন থেকে ঋণ নেয়া হবে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। 

এডিপি: বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এডিপি এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) অনুমোদন করেছে।

প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি: আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট্র সূত্র জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান, বাড়ানো, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি বিশেষ নজর রয়েছে সরকারের। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়তে চলতি অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় আগামী বাজেটেও করপোরেট করে ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

তবে ঢালাওভাবে সব খাতে নয়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত শিল্পের কর কমানো হচ্ছে। অপরিবর্তিত থাকছে মার্চেন্ট ব্যাংক, সিগারেট, জর্দা ও গুলসহ তামাকজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি এবং তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত মোবাইল কোম্পানির কর হার।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি করপোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পাইকারি ব্যবসায়ী, পণ্য পরিবেশক, ব্যক্তি মালিকানাধীন (প্রোপাইটরশিপ) প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের ওপর ন্যূনতম কর কমানো হচ্ছে। বর্তমানে ৩ কোটি টাকা বেশি টার্নওভার হলে লাভ বা ক্ষতি যাই হোক দশমিক ৫০ শতাংশ হারে ন্যূনতম কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে।

পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত নতুন শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন শুরুর পরবর্তী প্রথম তিন বছর ন্যূনতম কর হার দশমিক ১০ শতাংশ থাকছে। তবে মোবাইল অপারেটরদের লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে টার্নওভারের ওপর ২ শতাংশ এবং তামাক প্রস্তুতকারক কোম্পানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম করহার এক শতাংশ বহাল থাকছে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের বার্ষিক (টার্নওভার) লেনদেনে বিশেষ কর ছাড় থাকছে বাজেটে।

টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত। বাজেটে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য টার্নওভারের সীমা ৭০ লাখ টাকা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে করোনার আঘাতে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে আসন্ন বাজেটে। এবারই প্রথম দেশের ১৫০টি উপজেলার সব বয়স্ক জন ও বিধবা নারীকে ভাতা দেওয়া হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় বাড়বে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানীভাতাও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ জনকে এ সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে।

বাজেটকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইট www.mof.gov.bd-এ বাজেটের সব তথ্যাদি ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাঠ ও ডাউনলোড করতে পারবে এবং দেশ বা বিদেশ থেকে উক্ত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফিডব্যাক ফরম পূরণ করে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ প্রেরণ করা যাবে।

প্রাপ্ত সকল মতামত ও সুপারিশ বিবেচনা করা হবে। জাতীয় সংসদ কর্তৃক বাজেট অনুমোদনের সময়ে ও পরে তা কার্যকর করা হবে। ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত সরকারি ওয়েবসাইট লিংকের ঠিকানাগুলোতেও বাজেট সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাবে। https://nbr.gov.bd, https://plandiv.gov.bd, https://imed.gov.bd, https://www.dpp.gov.bd, https://pmo.gov.bd।

(ঢাকাটাইমস/৩জুন/আরএ/ডিএম/)